ফাতেমা রহমান রুমা। জার্মান
প্রথম যখন জার্মান গেলাম, মনে হতো এ কোথায় এলামরে বাবা।
অদ্ভুত একটা দেশে এসে পড়েছি! এদেশের আকাশ সবসময় মেঘাচ্ছন্ন. সূর্য ওঠেই না বললে চলে! হয় বৃষ্টি নয়তো বরফ!!
বর্ষাকাল আমার খুবই প্রিয়. আমি তো বর্ষার মেয়ে, তাই বৃষ্টির সাথে আমার খুব আপন সম্পর্ক। কিন্তু এদেশের বৃষ্টিটাও বাজে! এরা অতি সন্তর্পণে ঝরবে! কেন রে বাবা! ঝমঝমিয়ে নাম না একবার!! তা নয়, টিপ টিপ করে পড়ছে। যেন একটু বেশি জোরে বৃষ্টি হলেই মাস্টারমশাই খুব বকে দেবে!
ঢাকায় অফিস যাওয়ার সময় খুব চাইতাম একটু মেঘ করুক, সেইসময় আমি অফিস পৌঁছে যাই টুক করে! আর এখানে চাইছি সূর্য উঠুক অন্তত আজকে! অনন্ত অপেক্ষা তবু সূর্য উঠছে না! সেই কবে ঢাকাই সূর্যের মুখ দেখেছিলাম!
আমার দেশের পেঁয়াজের রংটাও কি সুন্দর.কথাতেই আছে পেঁয়াজী রং! ও বাবা! এ দেশের পেঁয়াজ তো সবুজ!
এতো সবুজের বহর দেখলে আমাদের বোন ভারী খুশি হতো!
কি ভাগ্যিস গাজরের রংও সবুজ নয়!
এখানে আমি ঝাল পর্যন্ত মিস করছি। কারণ এরা ঝাল খায়না!
যদিও আমার মিস করার তালিকাটা বেশ দীর্ঘ!
সূর্য, পেঁয়াজ,চড়ুই, ফুচকা, লাল সবুজের, কাকের কা কা!
পায়রা আছে অনেক, সেগুলো খেয়ে খেয়ে এত্তো মোটা হয়ে গেছে! তাদের উড়তেও আলিস্যি! এক হাত উঁচু গাছে বাসা করে বসে আছে এবং অবশ্যই নো বক বকম!
জানালা দিয়ে তাকাবো কি! শুধুই বৃষ্টি! কাঁহাতক আর “শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে” গাওয়া যায়!!!
সবথেকে অসুবিধা হলো কথা বলা! এরা ইংরাজী বোঝে না, বলেও না! এ এক মহা জ্বালা! কথা না বলে বলে পেট ফেঁপে যাচ্ছে!
সূর্য নেই, কাক নেই, চড়ুই নেই…গাড়ির হর্ণ নেই!
নিস্তব্ধ চরাচর… টিপটিপ পা টিপে চলা বৃষ্টির দেশ।
তবে মানতেই হবে জার্মানির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অফুরান। বিকেলে হাঁটতে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে ড্যাফোডিলস, চেরি ব্লসম, টিউলিপ উঁকি মারছে চারদিক থেকে। এতো সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।এখন আমি পুরোদস্তর জার্মান ভক্ত।
ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে রাইন নদীর ধারে একটি সাজানো শহর মাইন্জ। ছাপাখানার আবিষ্কর্তা গুটেনবার্গের জন্মস্থান এখানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মাইন্জ ভয়াবহ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও গথিক ক্যাথেড্রাল, সাজানো-গোছানো রাইন নদীর তীর, গুটেনবার্গ মিউজিয়াম এ সব নিয়ে জমজমাট থাকে মাইন্জের আলস্টাড অর্থাৎ ওল্ড সিটি। গুটেনবার্গ ইউনিভার্সিটি এবং ম্যাক্স প্ল্যাংক রিসার্চ ইনস্টিটিউট থাকার জন্য মাইন্জে বিদেশি ছাত্রছাত্রী এবং গবেষকদের সংখ্যা যথেষ্ট।এই ইনস্টিটিউটে প্রথম করোনা নিয়ে লোকজন চিন্তিত হয় যখন মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে এ. পি. এস (আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি )-র মিটিং বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়। তখনও জার্মানির মাইন্জ অঞ্চলে করোনা আক্রান্তের কোনও তথ্য ছিল না। এর পরই ইমেল আসে জার্মানির সবচেয়ে বড় ফিজিক্স মিটিং জিপিএস (জার্মান ফিজিক্যাল সোসাইটি ) বাতিল হবার নোটিস। মার্চের ১৫ তারিখ থেকে জার্মানির অন্য একটি শহরে হওয়ার কথা ছিল। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইনস্টিটিউট থেকে জানানো হয়, কাজের সময় ন্যূনতম করা হবে। অর্থাৎ অতি প্রয়োজনীয় কাজের জন্য ইনস্টিটিউট খোলা থাকবে। ঘর থেকে কাজ করতে হবে। এখানে প্রায় ৪০ জন সদস্যের গ্রুপ পলিমার থিওরি নিয়ে কাজ করে। থিওরিটিক্যাল কাজের জন্য ইন্টারনেট আর একটি ল্যাপটপই যথেষ্ট। কারণ ইন্টারনেটের মাধ্যমে সুপার কম্পিউটারে কাজ করা হয় প্রতিষ্ঠনটিতে।ল্যাবরেটরিতে গিয়ে কাজ করতে হয় না। তাই সবার পক্ষে ঘর থেকে কাজ করা সম্ভব।
হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে। থিওরিটিক্যাল গবেষণার ক্ষেত্রে ইনস্টিটিউটে গিয়ে সকলের সঙ্গে আলোচনা, কফি ব্রেকে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের বাইরে অন্য বিষয়ে চর্চা না হলে মানসিক ভাবেও তো প্রত্যেকে ক্ষতিগস্ত হয়। অনলাইন কফি আড্ডা এটি পুষিয়ে নেবার চেষ্টা। গ্রুপের সমস্ত সদস্য চা বা কফি বানিয়ে সপ্তাহে দু’দিন বিকেলে নির্দিষ্ট একটা সময়ে কথা বলা। পুরোদমে চলছে জার্নাল ক্লাব, রিসার্চ, এমনকি জার্মান ভাষার ক্লাসও। আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যার যুগে বোধহয় অনেক কিছুই সম্ভব। বাড়ির খুব কাছেই সুপার মার্কেট। মার্চের প্রথম দিকে ক্যানড ফুড বা টয়লেট টিস্যু পেতে সমস্যা হলেও এখন আবার সব কিছু স্বাভাবিক। সুপারমার্কেটে লোকজন দূরত্ব বজায় রেখে ঢুকছে। নাহ, জিনিসপত্রের দামও আগের মতোই আছে। আগেথেকে অর্থাৎ ওষুধের দোকান খোলা। চলছে বাস, ট্রেন। যদিও সংখ্যাতে অনেকটা কম। এখানে কোনও লকডাউনের কঠোর নিয়ম নেই। মানুষ জন অনেকটা স্বেচ্ছায় নিয়ম মেনে চলছে। প্রত্যেকে হাঁটতে বা দৌড়াতে যেতে পারে। তবে ২ জনের বেশি একত্রিত হলে বেশ মোটা অঙ্কের জরিমানা হতে পারে। এই দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা লক্ষাধিক হলেও মৃতর সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। জার্মান চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বাহবা দিতেই হয়। কামনা করা যায় যত তাড়াতাড়ি করোনার ভ্যাকসিন বাজারে আসে সেটাই বোধহয় একমাত্র পথ এই মহামারীর সঙ্গে লড়াই করার।