পাঠাওয়ের মতো কোম্পানির মালিক হতে চান? হতে চান মার্ক জাকারবার্গের মতো বিখ্যাত উদ্যোক্তা? তাহলে আপনাকে স্টার্টআপ শুরু করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিতে কোটি কোটি টাকা নিয়ে বসে আছে!
হ্যাঁ, একটুও ভুল পড়েননি। গত ১৯ আগস্ট ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামের একটি সরকারি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে। প্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তারা এখানে আইডিয়া জমা দিলে এবং সেটি কর্তৃপক্ষের পছন্দ হলে কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই মিলবে বড় অঙ্কের ঋণ। কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ৫০০ কোটি টাকা। ২০০ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু হওয়ার কথা তাদের। প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য হবে ১০ টাকা। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্রান্ট হতে সহায়তা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০২০ সালের মধ্যে ১০০ জন উদ্যোক্তা তৈরি করা হবে। এ ছাড়া আইডিয়া প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে এক হাজার স্টার্টআপ তৈরি করা হবে।
এতটুকু পড়তে পড়তে আপনার চোখ নিশ্চয়ই চকচক করে উঠছে; হয়তো ভাসছেন স্টার্টআপ উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নে। কিন্তু বিপত্তি হলো আপনি কোনো দিন পিটার থিয়েলের লেখা জিরো-টু-ওয়ান বইটি খুলে দেখেননি! যদি তা-ই হয়, তবে আপনার জন্য স্টার্টআপ উদ্যোক্তা হওয়া কঠিন।
থিয়েল বিখ্যাত অনলাইন আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান পেপ্যালের পাঁচ প্রতিষ্ঠাতার একজন। আজকের বিখ্যাত কোম্পানি ফেইসবুকের প্রথম বহিরাগত বিনিয়োগকারী তিনি।
থিয়েলের বইটির একদম প্রথম প্যারা পড়লেই স্টার্টআপ সম্পর্কে আপনার দিনের আলোর মতো পরিষ্কার একটা ধারণা হবে। তিনি ইংরেজিতে যা লিখেছেন তার বাংলা অনুবাদ এমন, ‘পরবর্তী বিল গেটস অপারেটিং সিস্টেম বানাবেন না। পরে যে ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন আসবেন, তারা সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করবেন না এবং পরবর্তী মার্ক জাকারবার্গ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সৃষ্টি করবেন না। যদি আপনি এই মানুষগুলোর কাজ কপি করেন, তাহলে কিছুই শিখলেন না।’
কী বুঝলেন? থিয়েল এখানে মূলত নতুন কিছু করতে বলেছেন। আধুনিক যুগের ব্যবসায়ীরা এই নতুন আইডিয়াকেই স্টার্টআপ বলেন। অন্যদিকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা মানে প্রচলিত কোনো ব্যবসায় নেমে পড়া।
থিয়েল তার বইয়ে বলেছেন, প্রচলিত ব্যবসা থেকে কিছু করা মানে পৃথিবীকে জিরো থেকে ‘এন’-এ নেওয়া। আর নতুন কিছু শুরু করা মানে জিরো থেকে ওয়ানে যাওয়া। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, এখনকার দিনে জিরো থেকে ওয়ান মানেই প্রযুক্তিগত ব্যবসা। তাই আপনারও উচিত এটি নিয়ে ভাবা।
শুরুর আগে শুরু : কীভাবে স্টার্টআপ খুলতে হয়, এটি লিখে গুগলে সার্চ দিলে আপনি অনেক লেখা পাবেন। সেখানে সুন্দর সুন্দর পরামর্শ আছে। কিন্তু অধিকাংশ লেখায় ‘শুরুর আগের শুরু’র কথা পাবেন না।
একটি প্রতিষ্ঠান চালু করতে গেলে প্রতিটি দেশের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মানতে হয়। বাংলাদেশেও আছে। সেই নিয়ম মেনে কাগজপত্র ঠিক না করলে ভারী ভারী সব আইডিয়া তারার মতো আকাশে সুন্দর হয়েই পড়ে থাকবে। কোনো ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান আপনাকে মূলধন দেবে না। কোম্পানি নিবন্ধন নিজে করতে গেলে অনেক ঝামেলা। তাই পরিচিত ভালো কোনো আইনজীবীর মাধ্যমে এটি করিয়ে নিতে পারেন। তাতে কাগজপত্র ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে।
শুরু করুন দ্রুত
ব্যবসায় ‘ফার্স্ট মুভার অ্যাডভানটেজ’ বলে একটা কথা আছে। এটির অর্থ হলো, যে ব্যবসায়ী সবার আগে মার্কেটে প্রবেশ করবেন, তিনি বাড়তি সুবিধা পাবেন। কাগজপত্র প্রস্তুত হয়ে গেলে, নিজে কিছু একটা শুরু করুন। কেন শুরু করতে হবে তার উত্তর দিয়েছেন রিদ্মিকের নির্মাতা শামীম হাসনাত, ‘শুধু আইডিয়া থাকলেই কেউ আপনার স্টার্টআপে বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। নিজে কিছু একটা করে নিয়ে গেলে বরং মূলধন পাওয়া সহজ হয়।’
কী করবেন
এখন আপনার মনে হতে পারে, ‘আসলে কী শুরু করব? সবই তো অন্যরা করে ফেলেছে!’ এমনটি সবারই মনে হয়। কিন্তু মূল ব্যাপার হলো পৃথিবীতে আইডিয়া অন্তহীন। ফেইসবুক, গুগল আবিষ্কারের আগে মানুষের কাছে বিষয়গুলো অপ্রত্যাশিত ছিল। যারা তৈরি করেছেন, তারাও আজকের মতো করে শুরুর সময়ে ভাবতে পারেননি। কাজ করতে করতে প্রতিষ্ঠানগুলো এই জায়গায় এসেছে।
পিটার থিয়েল তার বইয়ের ‘সিক্রেটস’ অধ্যায়ে বিষয়টি দারুণভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে তিনি জানিয়েছেন কীভাবে নতুন আইডিয়ার সন্ধান করতে হয়। তিনি বলছেন, কোম্পানি তৈরির সময় দুটি বিষয় ভাবা উচিত। এক. প্রকৃতির কী রহস্য আপনি জানেন না? দুই. মানুষের কী রহস্য আপনার কাছে অজানা?
অর্থাৎ থিয়েল মনে করেন, নতুন আইডিয়া লুকিয়ে থাকে ‘প্রকৃতির গোপনীয়তা’ কিংবা ‘মানুষের গোপনীয়তা’র ভেতর। প্রাকৃতিক গোপনীয়তা আমাদের চারপাশেই ঘুরে বেড়ায়। জহুরি চোখ দিয়ে সেটি চিনে নিতে হয়। প্রকৃতির কী প্রতিবন্ধকতা আপনি জয় করতে পারলে মানুষের জীবন আরও সহজ হতে পারে, এভাবে ভাবতে হবে। মানুষের গোপনীয়তা আবার একটু আলাদা; এটি এমন কিছু বিষয় যা মানুষ নিজেই জানে না কিংবা কাউকে জানাতে চায় না।
এতটুকু আপনার জন্য বোঝা কঠিন মনে হলে থিয়েলের পরবর্তী পরামর্শ মানতে পারেন। তিনি বলেছেন, নতুন আইডিয়া বের করার সহজতম উপায় হলো অজানাকে ভালোবাসা। যেখানে কোনো মানুষ হাত দেয়নি, যা নিয়ে আগে কেউ ভাবেনি সেসব নিয়ে ভাবা। সে ড়্গেত্রে এভাবে নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত, ‘আমার চারপাশে কী আছে, যা মানুষের দরকার; কিন্তু সেটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কেউ ব্যবহার করেনি। আমার প্রতিবেশীদের কী এমন দরকার, যেটি আরও সহজে তারা পেতে পারে?’
মূলধন
আইডিয়া ঠিক করার পর আসবে টাকার প্রসঙ্গ। নতুন ভাবনা মানেই সেটি ঝুঁকির ব্যাপার। বিষয়টি একদম নতুন বলে অর্থও বেশি দরকার হবে। অধিকাংশ সময় সেটি উদ্যোক্তার কাছে থাকে না। এই সমস্যা কীভাবে মেটাবেন সে সম্পর্কে এই লেখার শুরুতে ধারণা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে সরকার টাকা নিয়ে বসে আছে। এক জায়গায় আবার ভেঞ্চার ক্যাপিটালের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
যেসব ব্যবসা তুলনামূলক বেশি ‘অনিশ্চিত’ কিংবা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’, কিন্তু আইডিয়ায় নতুনত্ব আছে, আছে দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির সম্ভাবনা; কিন্তু উদ্যোক্তার একার সামর্থ্য নেই কাজ করার, সেসব ব্যবসায়ই ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানির সাহায্য নেওয়া হয়। এ ধরনের বিনিয়োগকারীদের বলা হয় ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট।
শুরুতে যে ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড’র কথা বলা হয়েছে, সেটি সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানাধীন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি। এখানে তথ্যপ্রযুক্তি সচিব কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং মোট পরিচালক সাতজন। সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটির বাইরে বাংলাদেশে আরও বেশ কয়েকটি বেসরকারি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান আছে।
এ ধরনের প্রতিষ্ঠান মূলত বিনিয়োগকারী এবং উদ্যোক্তার মধ্যে একটি ‘সেতু’ হিসেবে কাজ করে। মনে করুন, আপনার কোম্পানি থেকে আপনি একটি ব্যবসা করতে চাচ্ছেন, কিন্তু আপনার কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ নেই। তখন আপনি আইডিয়া নিয়ে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানির কাছে যাবেন। তারা আপনার প্রস্তাব বিশেস্নষণ করবে। সবকিছু দেখে তাদের পছন্দ হলে তারা কোনো বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে অর্থ নিয়ে আপনার সঙ্গে কাজ করবে। সব পক্ষের মধ্যে চুক্তি হবে। এখানে মূল উদ্যোক্তাকে প্রচলিত ধারণায় সুদ বলতে যা বোঝায়, সেটি দিতে হবে না। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল মূলত আপনার ব্যবসার অংশীদার হয়ে যাবে। যারা ব্যবসা সফল করতে সাহায্য করবে। চুক্তি অনুযায়ী লভ্যাংশ নেবে। বড় বড় প্রতিষ্ঠান বা বড় ব্যবসায়ী এই ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডে বিনিয়োগ করেন। সাধারণ বা খুচরা বিনিয়োগকারীকে এ ধরনের তহবিলে বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত করা হয়। কারণ এতে ঝুঁকি বেশি এবং ফল আসে দেরিতে।
ভেঞ্চার ক্যাপিটাল পেতে হলে আপনার প্রতিষ্ঠানের বয়স হতে হবে কমপক্ষে দুই বছর। নতুন যে ব্যবসা করতে চান, সেটি প্রপোজাল আকারে সুন্দর করে কোম্পানির কাছে উপস্থাপন করতে হবে। কোন কোম্পানি কী কী খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী তা তাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে কিংবা সরাসরি অফিসে গিয়ে জেনে নিতে পারেন। আপনার ধারণার সঙ্গে কারও কাজকর্ম যদি মিলে যায়, তাদের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যান। কীভাবে তারা প্রপোজাল চায়, সেটি ভালো করে জেনে নিন। প্রপোজাল তৈরি করতে পেশাদারদের সাহায্যও নিতে পারেন।
বাংলাদেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেভাবে নিজেদের কাজ এখনো শুরু করেনি, তাই সরকারি প্রতিষ্ঠানই ভরসা। স্টার্টআপ বাংলাদেশ ইতিমধ্যে শতাধিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে।
কোম্পানিটি মূলত তরুণ উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার দেয়। মোট ১৮টি ড়্গেত্রে এখান থেকে ফান্ড পাওয়া যেতে পারে : স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আর্থিক পরিষেবা, পরিবেশ, পরিবহন, পরিকাঠামো, কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, ফার্মাসিউটিক্যাল, ম্যানুফ্যাকচারিং, টু¨রিজম, মিডিয়া ও বিনোদন, ই-গভর্নমেন্ট, এম-গভর্নমেন্ট, ই-কমার্স, জৈবপ্রযুক্তি, রোবটিকস, সেমিকন্ডাক্টর/ন্যানোটেক/আইওটি এবং অন্য উপযুক্ত খাত।
যেকোনো বয়সী বাংলাদেশি ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’ থেকে ফান্ড নিতে পারবেন। নির্ধারিত িিি.ংঃধৎঃঁঢ়নধহমষধফবংয.মড়া.নফ ওয়েবসাইটে আবেদন করলে প্রাথমিকভাবে তাদের আইডিয়া মূল্যায়ন করা হয়। আইডিয়া পছন্দ হলে তাদের স্পিচ দেওয়ার জন্য ডাকা হয়। নির্বাচক কমিটির সদস্যরা স্পিচ দেখে সিদ্ধান্ত নেন, সেখানে বিনিয়োগ করবেন কি না।
বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দিয়ে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি থেকে সম্প্রতি ‘বিইউ স্টার্টআপ ক্লাবের’ যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১ কোটি টাকা সিড ফান্ড রয়েছে ক্লাবটির।
ভেঞ্চার ক্যাপিটাল জোগাড় করতে না পারলে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কাজ করতে পারেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এনজিও, যেমন গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা বাংলাদেশ ইত্যাদি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের জন্য ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের আওতায় ঋণ দিয়ে থাকে। তারা মূলত তৃণমূল পর্যায়ে এমন উদ্যোক্তাদের খুঁজে বের করে, যাদের জন্য ক্ষুদ্রঋণই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
যে কথা ভুলবেন না
ব্যবসায় ‘ফার্স্ট মুভার অ্যাডভানটেজ’ বলে যেমন কথা আছে, তেমনি ‘লাস্ট মুভার’ নিয়েও থিওরি আছে। অধিকাংশ স্টার্টআপ ব্যর্থ হয়। সেই ব্যর্থতা থেকে জন্ম নেয় নতুন কোনো গল্পের। তাই ব্যর্থতার ভয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে নিজের বলার মতো কোনো গল্প আপনি তৈরি করতে পারবেন না। প্রতিদিন শিখতে থাকুন। অর্থ জোগাড় হওয়ার পর শতভাগ নিবেদন নিয়ে কাজ করতে থাকুন। টিম গঠনে মনোযোগী হন। নিজে মাঠপর্যায়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখুন। দ্রুত শুরু করে ধীরে এগোতে থাকুন। বাজার জরিপ করুন। নিজের পণ্যের মান উন্নত করুন। বিক্রয়, বিপণন, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অপারেশন–এ চারটি ধাপ শক্তিশালী করুন। স্টার্টআপ ওয়েবভিত্তিক বা অ্যাপভিত্তিক হলে ভালো সফটওয়্যার ফার্মকে দিয়ে কাজ করান। সব সময় মাথায় রাখুন, সফলতা কোনো লটারির টিকিট নয়। ব্যর্থতা জয় করে ঘামের বিনিময়ে এটি পেতে হয়।