কী এই ওষুধ, আর কেনই বা একে নিয়ে এত মতান্তর?
করোনার চিকিৎসায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের ভূমিকা নিয়ে চলছে গবেষণা
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। করোনা-পরবর্তী জীবনে এই একটি শব্দ ইতিমধ্যেই
পরিচিত হয়ে উঠেছে। করোনা রুখতে এই ওষুধ নাকি ‘গেম চেঞ্জার’ হয়ে উঠতে পারে
বলে দাবি অনেকেরই। এই অনেকের মধ্যে চিকিৎসকদের একাংশ যেমন রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও।
তবে এই দাবির ভিন্ন মতও আছে বইকি। এক শ্রেণির চিকিৎসক আবার হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের কোনও ভূমিকা আছে এমন মানতে রাজি নন। তবে সারা বিশ্বেই এই ওষুধের প্রয়োগে করোনাকে খানিকটা প্রতিহত করা সম্ভব হওয়ায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে !
সাধারণ মানুষের মনেও এই ওষুধ নিয়ে নানা মত তৈরি হয়েছে। ওষুধের প্রয়োগ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সবই ভাবাচ্ছে তাদেরও। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে তারাও দ্বিধাবিভক্ত। করোনা-ত্রাসে খড়কুটোর মতো এই ওষুধকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছে একাংশ। অন্যরা আবার এর ক্ষতিকর দিক ও প্রয়োগের নানা জটিলতা নিয়ে চিন্তিত। কী এই ওষুধ, আর কেনই বা একে নিয়ে এত মতান্তর?
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কী?
ক্লোরোকুইন ফসফেট ম্যালেরিয়া সারানোর ওষুধ। সিঙ্কোনা গাছ থেকে এর মূল উপাদান পাওয়া যায়। ক্লোরোকুইনের হাইড্রক্সিলেটেড সল্টকে বলে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। এটি কাজে বা গঠনগত দিক থেকে অনেকটাই আমাদের খুব পরিচিত অন্য আর এক অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ওষুধ ক্লোরোকুইনেরই মতো। ম্যালেরিয়া ছাড়াও এটি অন্য কানেক্টিভ টিস্যু ডিসঅর্ডার যেমন লুপাস, রিউম্য়াটয়েড আর্থ্রাইটিস, জোগ্রেন সিন্ড্রোম ইত্যাদি রোগে এর ব্যবহার
হয়।
ফ্রান্সের মেডিটেরিয়ান ইনফেকশন ইউনিভার্সিটি হসপিটাল ইনস্টিটিউটে এই ওষুধ প্রয়োগ করা হয় ৪৮ জন করোনা আক্রান্ত রোগীর উপর। হাতেনাতে ফল মিলল। করোনা নিয়ে দিশাহারা পৃথিবীকে ফরাসি বিজ্ঞানীরা শোনালেন এ বার আশার কথা। এই ওষুধটির প্রয়োগে ৩-৬ দিনের মধ্যে রোগীদের শরীর থেকে গায়েব এই ভয়ানক ভাইরাস। এই ৪৮ জনের মধ্যে অবশ্য ছ’জনকে এর সঙ্গে অ্যাজিথ্রোমাইসিনের মতো আর একটি ওষুধও দেওয়া হয়। এই পরীক্ষার রিপোর্ট সামনে আসতেই হইচই পড়ে যায়। যদিও তার পর এই ওষুধ নানা দেশেই প্রয়োগ হয়। সেখানে কোথাও ফল মিলেছে, কোথাও মেলেনি। কোথাও বা রোগীর মৃত্যুও হয়েছে এই ওষুধের বাড়বাড়ি রকমের প্রয়োগে। সেখান থেকেই তৈরি হয়েছে সংশয়।
বিধাননগর এফডি ব্লকের বাসিন্দা সংকল্প দে যেমন করোনা রুখতে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের প্রয়োগ নিয়ে আশাবাদী। তাঁর মতে, “যদি এই ওষুধ দিলে রোগ কিছুটা রোধ করা যায়, তা হলে তো তা দেওয়াই উচিত। এই মুহূর্তে লকডাউন করেও তো সে ভাবে রোগের প্রকোপ কমছে না। আবার এত দিন লকডাউনে দেশের আর্থিক অবস্থাও খারাপ। তাই রোগমুক্তিতে এটা কাজে লাগানো তো ভালই!’’
কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও যে আছে!
এই হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের উপর ভিত্তি করেই যদি ভবিষ্যতের গবেষণাগুলো এগোয়, তা হলে দ্রুত কিছুটা নিষ্পত্তি মিললেও মিলতে পারে। ভারত সরকারও একে প্রোফাইল্যাক্টিক বা রোগ প্রতিরোধে সাহায্যকারী ড্রাগ হিসেবে ব্যবহার করার অনুমোদন দিয়েছে। এ বার এর প্রয়োগ ও ট্রায়াল অ্যান্ড এরর করে করে দেখা ছাড়া তো উপায় নেই! তবে রোগী বুঝে প্রয়োগ শুরু করাও দরকার।”
কিন্তু অনেকের মতের সঙ্গে একমত নন কালিন্দীর বাসিন্দা দেবযানী মিত্র। পেশায় ফার্মাসিস্ট। ওষুধপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া স্বাভাবিক ভাবেই আছে। বললেন, “দেখুন, এই ওষুধ সকলের শরীরে খাপ খায় না। প্রয়োগ করলেও আরও অনেক অন্য রোগভোগ ডেকে আনে। তাই শুধু কয়েক জনের উপর কাজ করেছে ভেবে নিয়েই একে সর্বজনীনের জন্য নিদান দিয়ে দেওয়া যায় না। তা ছাড়া মানবশরীরের বাইরে কোনও ভাইরাসের বিরুদ্ধেই হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের কার্যকারিতা সেই ভাবে প্রমাণিত নয়, এমনকি করোনার যে টাইপ, সেই ইনফুয়েঞ্জা ভাইরাসের উপরেও এটি কার্যকর নয় বলেই জেনেছি।” পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা যখন উঠলই তখন জেনে নেওয়া যাক, ঠিক কী কী সমস্যা এতে রয়েছে।
কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া?
এই ওষুধের প্রয়োগ সব শরীরের জন্য নয়। হৃদরোগীদের একটা শ্রেণির ক্ষেত্রে এই ওষুধ ‘কার্ডিয়াক অ্যারিদমিয়া’ নামের হৃদরোগ ডেকে আনে। বেশ কিছু সমস্যা— যেমন সোরিয়াসিস, পরফাইরিয়া, লিভারের অসুখ, অ্যালকোহলিজম ইত্যাদি থাকলে ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় বড় ক্ষতি হতে পারে। প্রেসক্রিপশন ছাড়া সাধারণ মানুষের এই ওষুধ খাওয়ার কথাই নয়। কারণ, সে ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে মারাত্মক। বিশেষত যাঁদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে, তাঁদের
ক্ষেত্রে প্রেসক্রিপশন ছাড়া এই ওষুধের ব্যবহার হার্ট ব্লক পর্যন্ত করে দিতে পারে।
‘হু’-এর নির্ধারিত সবচেয়ে নিরাপদ ও প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকায় ম্যালেরিয়ার কুইনাইন নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, এদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকার কারণেই ‘নিরাপদ’ হিসেবে ‘হু’ গণ্য করে না। বক্ষবিশেষজ্ঞ সুমিত সেনগুপ্তও এই মতের সঙ্গে একমত। তাঁর কথায়, “এই ওষুধের যত না কাজ, তার চেয়ে সাইড এফেক্টস অনেক বেশি।”
ফরাসি যে গবেষকদের পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে বিশ্ব জুড়ে এই ওষুধের এত চাহিদা বাড়ছে, ড্রাগ ট্রায়ালে অংশ নেওয়া সেই চিকিৎসকরাও স্বীকার করে নিয়েছেন, তাদের পরীক্ষা হয়েছে অত্যন্ত কম সংখ্যক মানুষের উপরে। ফলে ভরসা করার মতো ব্যাপকতা তাতে নেই। তা ছাড়া এই পরীক্ষা চলাকালীন ৬ জন অসু্স্থ হয়ে পড়েন। ফলে ড্রপ আউট করেন তাঁরা। তাই তাঁদের উপর আর
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন প্রয়োগ করা হয়নি। তবে তাঁরাও পরে করোনা-মুক্ত হয়েছেন।
কোভিড-১৯ ঠেকাতে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কাজে লাগে তার কিছুটা আভাস মিললেও, জানা গেলেও যত ক্ষণ না কন্ট্রোলড ক্লিনিকাল ট্রায়াল করা হচ্ছে, নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না এই ওষুধ কতটা কার্যকর। প্রেশক্রিপশন মেনে খেলেও বমি বমি ভাব, মাথার যন্ত্রণা, মাথা ঘোরা, পেট ব্যথা, ওজন কমে যাওয়ার মতো সমস্যাগুলো ছাড়াও কিছুটা মানসিক অবসাদের জন্ম দিতে পারে এই ওষুধ। তাই আরও বিস্তারিত গবেষণা ও ট্রায়াল অ্যান্ড এরর ছাড়া কোনও গতি নেই।
সংক্রামক ব্যধি বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দীও এই ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতির উপরেই ভরসা করার পক্ষে সায় দিচ্ছেন।
এক দিকে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের প্রকৃতি, করোনার উপর এর কার্যকারিতা ও এই ওষুধ থেকে জন্মানো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, সব নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্য দিকে গত কয়েক দিন ধরে সাধারণ মানুষ দেদার হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন সংগ্রহ করতে শুরু করায় যাঁদের সত্যিই বিভিন্ন সমস্যায় এই ওষুধ খেতে হয়, তাঁদের অনেকেই নানা দোকান ঢুঁড়েও এই ওষুধ পাচ্ছেন না। সে-ও তৈরি করছে এক নয়া সমস্যা। বিশেষ করে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, বাড়াবাড়ি রকমের ডায়াবিটিস থাকলেও এই ওষুধ দেওয়া হয়। এখন এই রোগীরা সে ওষুধ না পেয়ে পড়েছেন অকূলপাথারে।