ইউভাল নোয়াহ হারারি
প্রবল পরাক্রমশালী এই ঝড় থামবেই একদিন । ভবিষ্যতের দিনগুলোতে আমাদের জীবনধারা বদলে দেবে, টিকে থাকার আমদের এখনকার সিদ্ধান্তগুলো নেব কিংবা যে বিকল্পগুলো বেছে নেব,তার উপর। মানব সভ্যতা এখন এক সামগ্রিক সংকট মোকাবেলা করছে। আমাদের এই প্রজন্মের সবচেয়ে বড় সংকট, এটা চোখ বুজে বলা যায়। বিভিন্ন সরকার এবং জনগন আগামী কয়েক সপ্তাহে যে সিদ্ধান্তগুলো নেবে তা আমাদের ভবিষ্যত পৃথিবীর গতিপথ, চরিত্র বদলে দেবে। এই বদলে যাওয়াটা যে শুধু আমাদের স্বাস্থ্যপরিষেবা পদ্ধতিতে হবে, ব্যাপারটা তেমন নয়। বদলে যাবে আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সংস্কৃতির গতিপথ। আমাদের খুব শক্ত এবং স্থির কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে, দ্রুত নিতে হবে এবং মাথায় রাখতে হবে সিদ্ধান্তের সুদূরপ্রসারী প্রভাব। এখন আমাদের শুধু সাময়িক বিপদ উদ্ধারের কথা মাথায় রাখলেই চলবে না, বরং ভবিষ্যতে কেমন একটা পৃথিবীতে আমরা বাস করতে চাই, সেটিও মাথায় রাখতে হবে। হ্যাঁ, এই আগুনের দিনগুলো শেষ হবে একদিন, টিকবে মানবসভ্যতা, আমাদের বেশিরভাগই বেঁচে থাকব- কিন্তু বেঁচে থাকব এক ভিন্ন পৃথিবীতে।
নানা ধরনের স্বল্পমেয়াদী জরুরি অবস্থা তখন আমাদের জীবনে হয়ে যাবে ডালভাতের মতো। খুব বড়সড় বিপর্যয় বা জরুরি অবস্থার চরিত্রই এরকম। ঐতিহাসিক সমস্ত প্রক্রিয়াকে খুব দ্রুত ঘটিয়ে ফেলে। সাধারণ সময়ে আমাদের যে সিদ্ধান্ত নিতে এবং বাস্তবায়নে লেগে যেত বছরের পর বছর, বড়সড় বিপর্যয়ে তা হয় অসম্ভব দ্রুত। অপরিণত এমনকি খুব বিপদজনক প্রযুক্তিকেও এ অবস্থায় ঠেলেঠুলে কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়, কারণ ওর চেয়ে কিছু না করা আরও বেশি বিপদজনক। একটা দেশ তখন কিন্তু বেশ বড় মাপে একটা সামাজিক নিরীক্ষার জায়গা হয়ে যায়। যেমন সবাই বাড়িতে থেকে কাজ করলে এবং দূরত্ব মেনে যোগাযোগ বজায় রাখলে কী হয়? সমস্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে চলে গেলে কি ঘটনা ঘটবে? স্বাভাবিক সময় কোন দেশের সরকারই এ ধরনের কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রাজি হতো না। কিন্তু এখন তো সময় স্বাভাবিক নয়। এক ক্রান্তিকাল আমরা পার করছি।
এই সংকটের সময়টায়, আমাদের হাতে দুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প বা রাস্তা আছে বলা যায়। প্রথমটি হচ্ছে একদম নিশ্ছিদ্র নজরদারী এবং নাগরিক ক্ষমতায়ন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে জাতি বা দেশভিত্তিক বিচ্ছিন্নকরণ এবং বৈশ্বিক সংহতি।
নিশ্ছিদ্র নজর দারী
মহামারী আটকাতে হলে গোটা জনগোষ্ঠীকে একটা নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। কাজটি করার জন্যে রাস্তা আছে দুটি। একটা হচ্ছে সরকার তার জনগনকে নজরদারীর মধ্যে রাখবে এবং নিয়মকানুন মেনে না চললেই শাস্তির ব্যবস্থা। আজ মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই প্রথম, প্রতিটা মানুষকে তীক্ষ্ণ নজরদারীতে রাখা যাচ্ছে প্রতিটা মুহূর্তে। ৫০ বছর আগেও রাশিয়ার কেজিবির ২৪০ মিলিয়ন রাশিয়ান নাগরিকের উপর ২৪ ঘণ্টা নজরদারীর কথা ভাবতেও পারত না, অথবা যে যে তথ্য প্রতিদিন তাদের হাতে আসত তা দিনেরটা দিনেই বিশ্লেষণ করার কথা ছিলো কল্পনার বাইরে। কেজিবিকে নির্ভর করতে হত নিজেদের মানুষ এজেন্ট এবং অ্যানালিষ্টদের উপর। এজেন্ট দিয়ে তো আর প্রতিটা নাগরিকের উপর নজরদারী করা সম্ভব নয়। রক্তমাংসের এজেন্টের বদলে এখন সরকারগুলো দেশের সবখানে ছড়িয়ে থাকা সেন্সর আর শক্তিশালী অ্যালগরিদমের মাধ্যমে কাজটা করতে পারে খুব সহজেই।
করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধের এই যুদ্ধে বেশ কয়েকটি দেশের সরকার ইতিমধ্যেই নতুন সব সারভেইল্যান্স টুল ব্যবহার করেছে এবং করছে। সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে চীনে। আমজনতার স্মার্টফোন খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে, কয়েকশো মিলিয়ন ফেস-রিকগনাইজিং ক্যামেরা ব্যবহার করে, জনগনকে নিজেদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা এবং অবস্থা রিপোর্টে বাধ্য করে চাইনিজ সরকার শুধু দ্রুত ভাইরাস বাহক শনাক্তকরণই নয়, সেই বাহকের চলাফেরা ট্র্যাক থেকে শুরু করে কাদের সংস্পর্শে ভাইরাস বাহক ছিলো তাও বের করে ফেলেছে অসম্ভব দ্রুত গতিতে। এর সাথে আবার মোবাইলের বেশ কিছু অ্যাপ সাধারণ জনগনকে আশপাশের সংক্রমিত রোগী সম্পর্কে সাবধান করে দেয়ার কাজও করেছে।
চীন যে ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে সে ধরনের প্রযুক্তি যে শুধু পূর্ব এশিয়াতেই আছে, তা কিন্তু নয়। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, ইসরাইল সিকিউরিটি এজেন্সি সন্ত্রাসী হামলা ঠেকাতে যে সার্ভেইল্যান্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে, সেই সার্ভেইল্যান্স প্রযুক্তি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন শুধুমাত্র করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ট্র্যাক করার জন্য। তাতে সংসদীয় উপকমিটি বাগড়া দিলেও নেতানিয়াহু ‘ইমার্জেন্সি ডিক্রি’ বলে দুই শব্দে সমস্ত আপত্তি উড়িয়ে কাজটি শুরু করে দিয়েছেন।
আমার বক্তব্যের এই পর্যায়ে এসে আপনি বলতেই পারেন, এইসব তো নতুন কিছু না। সম্প্রতি বিভিন্ন সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জনগনকে ট্র্যাক, মনিটরিং এবং নানাভাবে ব্যবহার করার জন্য খুবই উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তারপরেও আমরা যদি সাবধান না হই, এই ধরনের মহামারী বা অতিমারীগুলো সার্ভেইল্যান্সের ইতিহাসে দাগ রেখে যাবে। বন্যার জল নেমে যাবার পর দেয়ালের গায়ে যেরকম দাগ থেকে যায় অনেকটা ওরকম দাগ । এর কারণ হচ্ছে, যে দেশগুলো নিজেদের জনগনের উপর নজরদারীতে বিশ্বাস করে না, তারাও কঠিন নজরদারীর জন্যে প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এতদিন যে নজরদারী ছিল আংশিক বা অনেকটা বাইরে থেকে, নজরদারী হবে এখন ঘরের ভেতরে, একদম আপনার হাঁড়ির ভেতর। সার্ভেইল্যান্স ‘ওভার-দ্য স্কিন’ থেকে হয়ে যাবে ‘আন্ডার-দ্য-স্কিন’।
এখন পর্যন্ত আপনার স্মার্টফোনের স্ক্রিনে কোন লিঙ্কে আপনি যখনই আঙ্গুল দিয়ে ক্লিক করেছেন, সরকার শুধু জানতে চেয়েছে, কিসের লিঙ্কে আপনি ক্লিক করেছেন। কিন্তু এই করোনা ভাইরাসের কারণে সরকারের ফোকাসটা সরে গেছে অন্যদিকে। এখন সরকার জানতে চায় আপনার আঙ্গুলের তাপমাত্রা কতো, ত্বকের নীচে আপনার রক্তের চাপ কতো।
জরুরী অবস্থা এবং পুডিং তৈরির এক হাস্যকর আইন
সার্ভেইল্যান্সের ক্ষেত্রে আমরা এখন বিচিত্র একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, আমরা জানি না আমাদের উপর সার্ভেইল্যান্স কীভাবে করা হচ্ছে এবং সামনের দিনগুলোতে এর ফলাফলটা কীরকম। নির্দ্বিধায় বিষয়টা একটা সমস্যা। সার্ভেইল্যান্স প্রযুক্তি ভয়াবহ দ্রুত গতিতে উন্নত হচ্ছে, দশ বছর আগে যে বিষয়টা ছিলো নিখাদ সায়েন্সফিকশন, এখন সেটাই পুরোনো খবর। একটা থট এক্সপেরিমেন্ট করা যাক, ধরা যাক, কোন এক দেশের সরকার চাইল যে তার দেশের প্রতিটি নাগরিক হাতে একটি বায়োমেট্রিক ব্রেসলেট পরবে। সেই ব্রেসলেট একদম ২৪ ঘণ্টা নাগরিকদের শরীরের তাপমাত্রা ও রক্তচাপ মনিটর করতে থাকবে। শুধু মনিটরিং ই না, এই ডেটা চলে যাবে সরকারের ডেটাবেজে। সেখানকার অ্যানালিসিস এবং অ্যালগরিদমের মাধ্যমে আপনি নিজে জানার আগেই সরকার জেনে যাবে আপনি অসুস্থ্য, তারা এও জানবে আপনি কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন, কাদের সাথে মিশেছেন। সংক্রমণের চক্রটা তখন খুব দ্রুত চিহ্নিত করে ছোট করে ফেলা যাবে, এমনকি বন্ধই করে দেয়া যাবে। এ ধরনের একটা সিষ্টেম খুব সহজেই একটা মহামারীকে একদম দিন কয়েকের মাঝেই ঠাস করে আটকে দিতে পারে। শুনতে খুবই ভালো লাগছে, তাই না?
এর খারাপ দিক অবশ্যই আছে। এর ফলে ভীতিকর একটি সার্ভেইল্যান্স ব্যবস্থা আইনগতভাবে বৈধতা পেয়ে যাবে। উদাহরণ হিসেবে বলি, যদি আপনি জানেন যে আমি সিএনএন এর লিংকের বদলে ফক্স নিউজ চ্যানেলের একটি লিঙ্ক ক্লিক করেছি, এই ডেটা থেকে আপনি জেনে যেতে পারেন আমার রাজনৈতিক দর্শন কি। এমনকি আমার ব্যক্তিত্বের কোন একটা বিশেষ দিকও হয়তো এখান থেকেই বেরিয়ে আসবে আপনার হাতের মুঠোতে। কিন্তু একটা ভিডিও ক্লিপ দেখতে দেখতে আমার শরীরের তাপমাত্রা, রক্তচাপ এবং হৃৎপিণ্ডের গতির পরিবর্তন- এইসব তথ্য যদি আপনার হাতে চলে যায় আপনি তখন জেনে যাবেন কোন বিষয়টা আমাকে হাসায়, কিসে আমার কান্না পায় এবং কোন জিনিসটায় আমার প্রচণ্ড ক্রোধের সৃষ্টি হয়। আমার খুব রাগ হয়!
একটা জরুরি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, আনন্দ, বিষাদ, ক্রোধ, বিষন্নতা, ভালোবাসা, শরীরে জ্বর কিংবা সর্দির মতোই একটি জৈবিক বিষয়। যে প্রযুক্তির মাধ্যমে আপনার শরীরের কাশি শনাক্ত করা যাচ্ছে, সেই একই প্রযুক্তি দিয়ে আপনার হাসিও শনাক্ত করা যাবে। যদি সরকার বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের এইসব বায়োমেট্রিক ডেটা বা তথ্য জমা করা শুরু করে, তাহলে আমরা আমাদের নিজেকে নিজে যতোটুকু চিনি তার চাইতে বেশি আমাদের চিনবে সরকার বা সেই বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। তখন তারা আমাদের অনুভূতিই যে আগে থেকে বলে দিতে পারবে ব্যাপারটা শুধু তা না, তারা আমাদের আবেগ নিয়ে খেলতে পারবে, আমাদের কাছে বিক্রি করতে পারবে যে কোন কিছু। তা সে ভোটের জন্য একজন রাজনীতিবিদই হোক কিংবা একটা ভৌত পণ্য। বায়োমেট্রিক এই মনিটরিংয়ের কাছে ক্যামব্রিজ অ্যানালাইটিকার ডেটা হ্যাকিং ট্যাকটিকস হচ্ছে প্রস্তর যুগের একটা জিনিস। কল্পনা করুন ২০৩০ সালে উত্তর কোরিয়াতে প্রতিটি নাগরিককে এরকম একটি করে বায়োমেট্রিক ব্রেসলেট পরিয়ে দেয়া হয়েছে, সেই ব্রেসলেট আবার মাসের ত্রিশ দিন চব্বিশ ঘণ্টা হাতে রাখতে হয়। তখন উত্তর কোরিয়ার মহান নেতার ভাষণ শুনে আপনার ব্রেসলেট যদি শনাক্ত করে যে আপনি ভাষণ শুনে রেগে গিয়েছেন, আপনি শেষ।
‘জরুরী অবস্থা’ চলাকালীন সময়ে এ রকম বায়োমেট্রিক সার্ভেইল্যান্স সাময়িক সমাধানের পদক্ষেপ হিসেবে নেয়াই যায়, আপনিও তাতে সমর্থন করবেন। সেই জরুরি অবস্থা উঠে গেলে বা সরে গেলে এরকম সার্ভেইল্যান্সয়ের প্রয়োজন থাকে না। সমস্যা হচ্ছে এ ধরনের সাময়িক সমাধানের পদক্ষেপগুলোর একটা বিশ্রী চরিত্র আছে। একের পর এক ইমার্জেন্সি আসতেই থাকে, সাময়িক বিষয়গুলো সাধারণ জনগনের উপর স্থায়ী হয়ে যায়। একটা উদাহরণ দিই, আমার মাতৃভূমি, ইজরাইল ১৯৪৮ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘জরুরী অবস্থা’ ঘোষণা করে দিলো। জরুরী অবস্থার মাঝে প্রেস সেন্সরশিপ, জমি উপগ্রহণ থেকে শুরু করে পুডিং বানানোর। উপরেও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিলো (ঠিকই পড়েছেন। পুডিং বানানোর উপরেও আমার দেশে কিছু বিধিনিষেধ ছিলো।) স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হয়েছে সেই কবে, কিন্তু ইজরাইলের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ‘জরুরি অবস্থা’ আর শেষ হয়নি এবং সেই ১৯৪৮ সালের সাময়িক সেই ব্যবস্থার কিছুই আর সরেনি। (২০১১ সালে অবশ্য সৌভাগ্যক্রমে পুডিং এর উপর থেকে বিধিনিষেধ উঠেছে।)
যখন করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কমতে কমতে শূন্যে এসে দাঁড়াবে, কিছু ডেটা-হাভাতে সরকার তর্ক করতেই পারে এই বলে যে বায়োমেট্রিক সার্ভেইল্যান্স রাখতে হবে, কারণ করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয়বার আক্রমণের আশংকা আছে কিংবা সেন্ট্রাল আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাসের নতুন কোন স্ট্রেইন হয়েছে। এতোক্ষণে বুঝে গেছেন নিশ্চয়ই, ঘটনাটা আসলে কি। গেলো কয়েক বছর ধরেই আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয় নিয়ে বেশ একটা শীতল যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে করোনা ভাইরাস একটা টিপিং পয়েন্ট হতে পারে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং বেঁচে থাকা, এই দুটি বিষয়ের মধ্যে যেকোন একটি বিষয় যখন কাউকে বেছে নিতে বলা হবে, নিশ্চিতভাবেই বলা যায় সে বেঁচে থাকতে চাইবে, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা একজন মানুষের ‘ফার্স্ট প্রায়োরিটি’ নয়।
দরকার বৈশ্বিক একটা পরিকল্পনা
যে জরুরি বিষয়টি এখন আমাদের সামনে তা হচ্ছে জাতি বা দেশভিত্তিক বিচ্ছিন্নকরণ এবং বৈশ্বিক সংহতি। মহামারী নিজে এবং এর কারণ তৈরি হওয়া ইকোনোমিক ক্রাইসিস বা অর্থনৈতিক সংকট আসলে বৈশ্বিক সমস্যা। এই সমস্যার কার্যকরী সমাধান শুধুমাত্র বৈশ্বিক সহযোগীতার মাধ্যমেই করা সম্ভব।
ভাইরাসকে পরাজিত করতে প্রথমত এবং সবার আগে যে বিষয়টা করা জরুরি তা হচ্ছে সকল তথ্য সবার জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া। ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের এই জায়গাটাতেই এগিয়ে আছে। চীনে থাকা একটা করোনা ভাইরাস এবং আমেরিকায় থাকা একটা করোনা ভাইরাস কীকরে মানুষকে সংক্রমিত করতে হবে, সে বিষয়ক কোন তথ্য নিজেদের মধ্যে দেয়ানেয়া করতে পারছেনা। কিন্তু চীন কিভাবে করোনার বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে তা আমেরিকাকে শেখাতে পারে খুব সহজেই। মিলানে একজন ইটালিয়ান চিকিৎসক করোনা নিয়ে সকালে যে তথ্য আবিস্কার করছেন সেই তথ্য নিয়ে বিকালেই হয়তো তেহরানে আরেকজন চিকিৎসক রোগী বাঁচাতে কাজে লাগাতে পারবেন। ব্রিটেনের সরকার আজ যেসব বিষয়ে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধায় ভুগছেন, তারা হয়তো এই মাস খানেক আগেই একই সমস্যা মোকাবেলা করা কোরিয়ান সরকারের কাছ থেকে সাহায্য নিতে পারেন। কিন্তু এই কাজটির জন্য আমাদের দরকার, বৈশ্বিক সহযোগিতার এবং বিশ্বাসের একটা জায়গা।
সামনের দিনগুলোতে আমাদের সবার উচিৎ হবে সমস্ত কন্সপিরেসী থিওরি আর স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদদের এড়িয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্য বা সায়েন্টিফিক ডেটা আর স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকদের বিশ্বাস করা।
দেশগুলোর উচিৎ খোলামেলা তথ্য ভাগাভাগি করে নেয়ার পাশাপাশি অভিজ্ঞ দেশগুলোর কাছে উপযাচক হয়ে উপদেশও চাওয়া, শুধু তাই নয়, যে উপদেশ বা বৈজ্ঞানিক তথ্য তারা পাবেন তার উপর আস্থা রাখা। চিকিৎসার যন্ত্রপাতি, বিশেষ করে টেষ্টিং কিটস এবং রেসপিরেটরি মেশিন তৈরি এবং বিতরণেও দরকার বৈশ্বিক প্রচেষ্টা। নিজের নিজের দেশে যা আছে তা দিয়ে একা একা চেষ্টা না করে চেষ্টাটা হওয়া উচিৎ একটি সন্মিলিত ও সু-সংগঠিত প্রয়াস, যাতে করে জীবন বাঁচানোর এই যন্ত্রগুলো সবখানে সমানভাবে ছড়িয়ে পরে। যুদ্ধকালীন অবস্থায় একটা দেশ যেমন ব্যক্তিমালিকানাধীন বিভিন্ন কল-কারখানা রাষ্ট্রীয় আওতায় নিয়ে এসে কাজ করে তেমনি করোনার বিপক্ষে মানবজাতির এই যুদ্ধে সমস্ত ‘প্রোডাকশন লাইন’ হওয়া উচিৎ আরো মানবিক, গনমুখাপেক্ষী। একটা ধনী দেশ, যেখানে করোনা ভাইরাস কেসের সংখ্যা কম, সেই দেশের উচিৎ করোনার আঘাতে পর্যদুস্ত একটি দরিদ্র দেশে চিকিৎসা সহায়তা পাঠানো। তাদেরকেও তখন এই বিশ্বাস নিয়ে কাজ করতে হবে যে তাদের সাহাজ্যের দরকার হলে এরকম আরেকটি দেশ তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।
চিকিৎসকদের নিয়েও একইরকম বৈশ্বিক সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া যায়। যেসব দেশ করোনায় অপেক্ষাকৃত কম আক্রান্ত হয়েছে তারা তাঁদের চিকিৎসকদের করোনায় পর্যদুস্ত দেশে চিকিৎসা পরিষেবা দেয়ার জন্যে পাঠাতে পারে। যাতে তাদের দেশ আক্রান্ত হলেও অন্য দেশ একইভাবে এগিয়ে আসে। এতে অভিজ্ঞতারও একটি মূল্যবান বিনিময় ঘটবে। মহামারী দিক বদলালে সাহায্যের দিকটিও বদলাবে, এটিই হচ্ছে মূল কথা।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বৈশ্বিক সহযোগিতা। বিশ্বের অর্থনীতির চরিত্র এবং সাপ্লাই চেইনের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বলি, প্রতিটি দেশের সরকার যদি আশপাশের দেশগুলোর কথা না ভেবে এখন শুধু নিজেদের নিয়েই থাকে, সংকট বেড়ে এক জগাখিচুড়ি অবস্থা হবে। আমাদের তাই এখন দরকার একটা বৈশ্বিক কর্ম-পরিকল্পনা, এবং খুব দ্রুত দরকার।
আরেকটা যে জিনিষ দরকার তা হচ্ছে ভ্রমণের ক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক চুক্তি। মাসের পর মাস আন্তর্জাতিক ভ্রমণসূচী বাতিল করে দিলে কঠিন একটি অবস্থা তৈরি করবে এবং করোনার বিপক্ষে আমাদের যুদ্ধটাও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। জরুরি কাজে ভ্রমণার্থী যেমন বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের জন্যে দেশগুলোর দরকার একে অপরকে সহযোগিতা করা। এক্ষেত্রে ভ্রমণার্থীদের প্রথমেই নিজেদের দেশে প্রি-স্ক্রিনিং করে ছাড়পত্র দেবার পর গন্তব্যের দেশটি অনুমতি দেবে, এই শর্তে খুব সহজেই দেশগুলো একটি মতৈক্যে পৌঁছাতে পারে। খুব সাবধানে এবং যত্ন নিয়ে স্ক্রিনিং করার পর ছাড়পত্র পাওয়া একজন ভ্রমণার্থীকে আরেকটি দেশ সাদরেই বরণ করে নেয়ার কথা।
দুর্ভাগ্যবশত কোন দেশই এই কাজগুলো করছে না। পুরো বিশ্ব কেমন এক বৈকল্যে আক্রান্ত হয়েছে। মনে হচ্ছে এখন এখানে কোন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নেই, সব অপ্রাপ্তবয়স্কদের দল। যেখানে এই জরুরী অবস্থার জন্যে অনেক আগেই বিশ্ব নেতাদের বৈঠকের মাধ্যমে একটি বৈশ্বিক কর্মপরিকল্পনা যখন আসার কথা, সেখানে মাত্র গেলো সপ্তাহে জি৭ এর নেতৃবৃন্দ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একটি বৈঠক করেছেন। সেই বৈঠকেও কোন কর্ম পরিকল্পনার কথা উঠে আসেনি।
এর আগের বৈশ্বিক সংকট- যেমন ২০০৮-এর অর্থনৈতিক মন্দা এবং ২০১৪ সালের ইবোলা মহামারী- মার্কিন বিশ্ব নেতার ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সরকার বা তার প্রশাসন এই ভূমিকায় আসতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তাদের কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে মানব সম্প্রদায়ের ভবিষ্যতের চাইতে নিজেদের নিয়েই তারা মগ্ন আছে।
মার্কিন প্রশাসন তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্রদেরকেও ত্যাগ করেছে। ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে সমস্ত যাতায়াত বন্ধ করার আগে যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে কোনরকম কোন নোটিশ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি- আলোচনা তো দূরের কথা। উলটো স্ক্যান্ডাল ছড়িয়েছে যে তারা এক জার্মান ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানিকে এক বিলিয়ন ডলার দেবার প্রস্তাব করেছিলো করোনা ভ্যাক্সিনের উপর একক আধিপত্য বিস্তারের জন্য। এরকম একটি প্রশাসন যদি এখন বৈশ্বিক কোন কর্ম-পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসেও, এদের কেউ কি বিশ্বাস করবে? যে নেতা নিজের দোষ স্বীকার না করে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেন, যে নেতা নিজে সমস্ত প্রশংসা নিয়ে বাকীদের উপর চাপিয়ে দেন ব্যার্থতার দায়ভার, তাঁকে কেউ নেতা হিসেবে মেনে নেবেই বা কেন?
নেতৃত্বের শূন্যতার কারণে যে বিভেদ আমাদের মাঝে তৈরি হয়েছে, তার বিপদের কথা এখনকার এই মহামারী আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে একদম হাড়ে হাড়ে।
মানব সম্প্রদায়কে এখন একটা রাস্তা বেছে নিতে হবে। আমরা কি বিভেদের রাস্তায় হাঁটবো না বেছে নেবো সংহতির পথ? বিভেদের পথ বেছে নিলে এখনকার পরিস্থিতি যে শুধু আরো খারাপের দিকে যাবে, শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতেও পরতে হবে আরো বড় কোন বিপদে। আর যদি আমরা বেছে নিই সংহতির পথ, বিজয়টা শুধু করোনা ভাইরাসের বিপক্ষেই হবে না, হবে ভবিষ্যতের সমস্ত সংকটের বিরুদ্ধেও।
ফিনান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত এই লেখাটি অনূদিত