ডাঃ সুকুমার মুখোপাধ্যায়
সুকুমার মুখোপাধ্যায়। রাজ্য সরকারের নোভেল করোনা মোকাবিলায় তৈরি টাস্ক ফোর্সের প্রধান মুখ। নামজাদা অশীতিপর চিকিৎসক ডাঃ সুকুমার মুখোপাধ্যায় জানালেন কী কী পরিকল্পনা করলে তবেই জব্দ হতে পারে করোনা। সাক্ষাৎকার নিলেন বিশ্বজিৎ দাস।
সুকুমার মুখোপাধ্যায়। রাজ্য সরকারের নোভেল করোনা মোকাবিলায় তৈরি টাস্ক ফোর্সের প্রধান মুখ। নামজাদা অশীতিপর চিকিৎসক ডাঃ সুকুমার মুখোপাধ্যায় জানালেন কী কী পরিকল্পনা করলে তবেই জব্দ হতে পারে করোনা। সাক্ষাৎকার নিলেন বিশ্বজিৎ দাস।
কী পরিস্থিতি বুঝছেন?
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে আমাদের রাজ্য এখনও পিছিয়ে। বাজার, রেশনের দোকানে ব্যাপক ভিড় হচ্ছে। আইনকানুন মানা হচ্ছে না। না মানলে কিন্তু সমূহ বিপদ।
মুখ্যমন্ত্রীকে কি আপনি রেশন বিলিতে নিয়ন্ত্রণ আনার কথা বলেছেন?
কথা হয়েছে। উনি সব জানেন। সমস্ত খবর রাখেন। আমার তরফ থেকে যা যা প্রস্তাব রাখার রেখেছি।
রাজ্যজুড়ে এক প্রোটোকল?
হ্যাঁ। আর একটি বিষয় আমরা বারবার বলতে চাই। লকডাউন জোরদার করতে হবে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের একটি শৃঙ্খল আছে। সেটা ভাঙতেই হবে। এটাই আমাদের কাছে শপথ হওয়া উচিত। কোভিড ১৯ ভাইরাস ন্যূনতম তিনজনকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা রাখে। পরিবারের একজনের হলে তিনজনের হবে, তিনজনের হলে ন’জনের হবে।
একটা বিতর্ক ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। কোভিড রোগীর মৃত্যু আর কোভিড-এ মৃত্যু। দুটির ফারাক যদি স্পষ্ট করে দেন।
কোভিড রোগীর মৃত্যু নানা কারণে হতে পারে। ক্রনিক কিডনির অসুখ থাকতে পারে, হার্ট ফেলিওর-এর সমস্যা, সুগার থাকতে পারে। আসল কথা হল, তাঁর মৃত্যুর কারণ বা ‘কজ অব ডেথ’ কী? দ্বিতীয় বিষয় কোভিডে মৃত্যু। নোভেল করোনা থেকে ফুসফুসে সংক্রমণ হওয়ার পর ফুসফুস কাজ করা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিল। ব্যক্তিটি মারা গেলেন। এটাই কোভিডে মৃত্যু। কিন্তু, দেখ জেনিথ হাসপাতালের ঘটনাটি। রোগীর ক্রনিক কিডনির অসুখ ছিল। ডায়ালিসিস হচ্ছিল।
জেনিথ হাসপাতালের রোগীর সুগারও ছিল বোধহয়?
তিনি কীভাবে মারা গেলেন, সঠিকভাবে লেখা জরুরি। বলা হচ্ছে, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। বিনীতভাবে বলছি, আবেগের থেকে যুক্তিপূর্ণ হওয়া বেশি জরুরি।
প্রতিটি ঘটনায় ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ কি দেখছেন?
না, দেখিনি। তবে যেটুকু বুঝি, দুটি কারণ হতে পারে। একটি প্রাথমিক মৃত্যুর কারণ। দ্বিতীয়ত কো-মরবিডিটি। আগে থেকে কী রোগ আছে। কোনটার জন্য কোনটা হচ্ছে, সেই সিদ্ধান্ত চিকিৎসককেই নিতে হবে। রিস্ক ফ্যাক্টরগুলি দেখতে হবে। এগুলি থাকলে করোনা আক্রান্তের বাঁচার সম্ভাবনা কমে যায়। আর একটি হল, কোনও কো-মরবিডিটি নেই। কাভিড হল এবং শেষ পর্যন্ত তিনি মারা গেলেন। দেখ, জেনিথের ওই রোগীর রিস্ক ফ্যাক্টর ছিল অনেকগুলি। অন্যদিকে, পিয়ারলেসের রোগীর কোভিড ছাড়া সমস্যা বিশেষ ছিল না। করোনা রিপোর্টিং আরও নিঁখুত হওয়া উচিত।
যেটা মূল বলতে চাই, সেটা হল, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা যে কোনওভাবেই হোক আটকাতে হবে। বহু দেশ করোনা গ্রাফের কার্ভ সোজা করে আনছে। কার্ভ দু’রকমের হয়। একটি লিনিয়ার কার্ভ। অন্যটি লগ কার্ভ। লিনিয়ার কার্ভে শুধু সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া দেখায়। আজকে দুটো, কাল চারটে এমন। লগ কার্ভ-এ দেখায়, কত দ্রুত ছড়াচ্ছে। এই দ্রুততা আটকাতে হবে।
তাহলে কোভিড আক্রান্তের মৃত্যু, নাকি কোভিডে মৃত্যু, স্বাস্থ্যকর্তাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই বিস্তারিত কথা হয়েছে?
হ্যাঁ, অনেকক্ষণ। যেটা বলছ, সেটা গতকাল (বুধবার) আমি ডিএমইকে দিয়ে এসেছি। কখন করোনায় মৃত্যু বলা ঠিক হবে, কখন মৃত্যুর ক্ষেত্রে অন্যান্য অসুখকে কারণ বলে ধরা হবে। দেখা যাক, ওঁরা কী তৈরি করেন। আমি তারপর দেখে নেব।
ভারতবর্ষের পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগজনক?
এখনও দেশে এটি স্টেজ টু’তে রয়েছে। গোষ্ঠী সংক্রমণ হয়নি। তবে গ্রামাঞ্চলে আরও নজর দেওয়া জরুরি।
পশ্চিমবঙ্গে?
পরিস্থিতি খুব খারাপ নয়। মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, কেরলের মতো তো নয়ই। বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিক থেকে এখন এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ নম্বরে হল যথাক্রমে মহারাষ্ট্র, কেরল, তামিলনাড়ু, দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশ। আমরা এখনও তালিকায় নীচের সারিতে। শুধু, একটাই বিষয়, লকডাউন সফল করতে হবে।
আপনি এত সিনিয়র ফিজিশিয়ান? এর পর কী করা উচিত পশ্চিমবঙ্গের?
প্রথম কাজ করোনা কার্ভ ফ্ল্যাট করা। সংক্রমণের গতি আটকানো। ইতালি, আমেরিকার মতো দেশ প্রথমে বিষয়টিকে অত্যন্ত লঘুভাবে দেখেছে। এখন ঠেলা বুঝতে পারছে। ইতালিতে মৃতের সংখ্যা গত দু’দিন ধরে ১২ হাজার রয়ে গিয়েছে। আগামী চার-পাঁচদিনেই বোঝা যাবে, এই সংখ্যা বাড়ছে, নাকি ওরা সামলে নিতে পেরেছে।
আর পিপিই, মাস্ক নিয়ে যে বিতর্ক চলছে?
দিচ্ছে তো সরকার। যতটা সর্বোচ্চ সম্ভব, চেষ্টা করছে। স্বাস্থ্য কমিশনের চেয়ারপার্সন অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়ও পৌঁছে দিচ্ছেন।
১৪ তারিখের পর লকডাউন তোলা কি উচিত, নাকি নয়?
এখনই বলা মুশকিল। আগামী সপ্তাহে বলতে পারব। একান্তই নিজের মনে হয়, হয়ত আরও সাতদিন বাড়াতে হতে পারে। তবে আগামী দু’সপ্তাহ খুব গুরুত্বপূর্ণ। সোজা কথা বারবার বলছি, লকডাউন মানতে হবে। কোভিডের শৃঙ্খল ভাঙতে হবে।
দেখ একটি বিষয়, মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, এটা যেমন মর্মান্তিক, তেমনই অনেকে সুস্থ হয়ে ফিরছেন। সেই সাফল্যের কথাগুলিও জানাতে হবে। মৃত্যুহার দেখতে হবে। আমেরিকায় ধরো দুই লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু মৃত্যু হয়েছে পাঁচ হাজার জনের।
অনেকে যে বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে করোনায় মৃত্যুহার বেশি?
আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।
কারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন? কারা বেশি মারা যাচ্ছেন করোনায়?
বয়স্করা।
পশ্চিমবঙ্গে?
আমার কাছে সেই চার্ট নেই। বলা ঠিক হবে না।
সার্বিকভাবে?
প্রধানত বয়স্করা। আবার গতকাল দেখলে তো, তিনদিনের একটি বাচ্চা আক্রান্ত হয়েছে। তবে সার্বিকভাবে বয়স্করাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।
বলছেন ষাটের বেশি বয়স হলে খুব সাবধান?
দেখ আশি-নব্বই বছরের মানুষ বেশি বাইরে বের হন না। মৃতের তালিকায়ও দেখবে ওই বয়সি মানুষ খুব কম আছেন। বাইরে বের হন বেশি ৫০ থেকে ৭০ বছরের মানুষ।
তাহলে পরবর্তী পরিকল্পনা কী হওয়া উচিত?
কার্ভটি সমান করতে হবে। আর রাজ্যের সব জায়গায় সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ চিকিৎসা পৌঁছে দিতে হবে। ট্র্যাকিং, ট্রেসিং এবং টেস্টিং—এই তিনটি যত করা হবে, ততই বুঝতে পারবে, প্রকৃত পরিস্থিতি কোন জায়গায়। আর দরকার কোয়ারেন্টাইন।
একটি জিনিস বহু মানুষ জানতে চান। মোবাইল, হাতের আংটি, গলার হার, তাগা এইসব থেকে কি করোনা ছড়াতে পারে?
সাধারণত নয়। তবে কেউ যদি গলায় বিশাল হার পরেন, হাঁচি-কাশি হয়ে থাকলে ড্রপলেট পড়তে পারে। একটু আধটুতে হয় না। তবে করোনা ভাইরাসের স্থায়িত্ব দু-তিন ঘণ্টা। স্টিলে বেশ কয়েক ঘণ্টা থাকে। বিশেষত স্টিলের নব, হাতলে।
পশ্চিমবঙ্গে গোষ্ঠী সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে?
এখনও দেখছি না। তবে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। ওই যে বললাম, ভিড় আটকাতে হবে। না হলে সমূহ বিপদ।
সূত্র: বর্তমান পত্রিকা
জনস্বার্থে সাক্ষাৎকারটি কোনো এডিট ছাড়া ছাপানো হচ্ছে।