নবনীতা ভট্টাচার্য:
গুহার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। ঢালু জমি থেকে অন্ধকারে ঢুকে গিয়েছে গুহার মুখ। মরচে ধরা শুকনো পাতায় ঢাকা শুরুর পথ। হুড়মুড়িয়ে ঢুকতে গিয়ে বকুনি খেলাম। ভিতরে একটা ঠান্ডা হাওয়ার পড়ত অনুভব করলাম।
বহু আগে লামা দর্জি বলে কেউ একজন ঢুকেছিলেন গুহায়। ঘণ্টা দুই পরে বেরিয়ে আসেন। এই গুহার মুখ নাকি তিস্তায় গিয়ে বেড়িয়েছে। সিকিমের রাজারা নাকি এই পথে পালিয়ে যেতেন। যেখানে দাঁড়িয়ে এই সব ঘটনা শুনছি সেই জায়গাটার নাম সামথার। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে থেকে আটান্ন কিলোমিটার দূরে।
রেলি নদী পেরিয়ে আসতে হয়। খরস্রোতা রেলি নদীর ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে বসার মজাই আলাদা। নদীর উপর আছে ঝুলন্ত গইলাম ব্রিজ। একটু জোরে হাঁটলেই যা দুলতে শুরু করে। তিস্তাকে হাতের ডানপাশে রেখে ঢুকে পড়তে হয় সামথারের রাস্তায়। একটা নয় আরও একটা গুহা আছে ঠিক উল্টো দিকে। তার মুখ অবশ্য ভিজে মাটি দিয়ে বন্ধ।
চার পা মতো এগলাম। ভিজে মাটি লেগে আছে গুহার দেওয়ালে। হাতে মাটি নিয়ে সেই গন্ধ অনুভব করলাম। মনে হল, এই মাটির গন্ধটুকুর আশাতেই ছিলাম হয়তো।
সামথার পৌঁছতে পৌঁছতেই সন্ধে হয়ে গেল। ট্রেন থেকে নেমে শিলিগুড়িতে এক বন্ধুর বাড়ি তারপর রেলি নদীর ওপর অনেকটা সময় কাটিয়ে ফেলাতেই এই দেরি।
রেলি নদীর পাশে ভুজেল সম্প্রদায়ের উত্সব দেখতেও দাঁড়িয়ে
পড়েছিল আমাদের গাড়ি। তাই সামথারে যখন ঢুকলাম, তখন দোকানপাট বন্ধ হয় হয়। এতটা সময় বাইরে থাকায় দরুণ কাঁপুনি দিচ্ছে।
হোম স্টে-তে ঢুকতেই ওডিকোলনের গন্ধমাখা উষ্ণ তোয়ালে দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হল। আরামে প্রায় চোখ জুড়িয়ে এল। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বসার জায়গা। বেতের সোফা। দেওয়ালের ছবি আর রঙে শান্তিনিকেতনের অনুভূতি। সে রাতে ঘরে থাকা হল না। কারণ স্থানীয় এক বন্ধুর বাড়ির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তে হল।
বন্ধুর বাড়িতে লম্বা প্যাচানো সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গোল মতো ঘেরা জায়গাতে আমাদের বসার আয়োজন। ফুরিয়ে আসা চাঁদের আলোয় দেখলাম সামথারের চারিদিকে রয়েছে পর্বতশৃঙ্গ। মেঘ কাটলে দেখা যাবে কাঞ্চনজঙ্ঘাও। খেলাম ঘরে তৈরি নরম পরোটা আর তুলতুলে চিকেন। তার স্বাদ চাঁদের আলোকে আরও মোহময়ী করে তুলল।
রাতে ফেরার পথে গাড়ি খারাপ হল। ভগ্যিস! তাই গড়িয়ে আসা চাঁদের আলো গায়ে মেখে পাহাড়ি পাকদণ্ডী বেয়ে ফিরে এলাম অস্থায়ী আবাসে। তবে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল, এত আলো আবিষ্কার না হলেই বুঝি ভালো হতো।
চোখ সয়ে গেলে বোঝা যায় অন্ধকারেরও একটা মন কাড়া সৌন্দর্য আছে। চাঁদের আলো থাকলেও জায়গায় জায়গায় গাছ কেমন একটা ছমছমে পরিবেশ তৈরি করেছে। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই ঘুম এসে গেল।
পরদিন স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম গ্রাম ঘুরতে। ট্যুরিস্ট বলতে শান্ত গ্রামটাতে আমি একাই। সামথার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সেদিন ছিল বারো ক্লাসের বিদায় সংবর্ধনা। গানে কথায় কিছুক্ষণ সময় কাটালাম স্কুল প্রাঙ্গণে। এরপর পিচ ঢালা রাস্তা পেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। দেখে ফেললাম কমলালেবুর বাগান। সুন্দর গড়নের কমলালেবু ঝুলে রয়েছে গাছে। বড় এলাচের খেত। অযত্নে ঝুলে থাকা হৃষ্টপুষ্ট স্কোয়াশের গাছ। ঝাড়ুর গাছ। সবচেয়ে মজা লাগল এটা দেখে যে, সবাই রাস্তায় বসে রোদ পোয়াচ্ছে। ওর মধ্যেই টুকটাক যা বিক্রি বাটা হচ্ছে। চার মাথার মোড়টাকে হাতের বাঁ দিকে রেখে একটা বাঁধানো রাস্তা উঠে গিয়েছে উপরে। কথা বলে জানা গেল, ওই রাস্তা ধরে অনেকটা উপরে উঠে ঝাণ্ডি বলে একটা জায়গায় স্থানীয় লোকজন রোদ পোহাতে যায়। রোদ উঠলেও কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা নেই। সারাদিন মেঘে মুখ ঢাকা।
মেঘলা থাকায় পনবু যাওয়া হল না। সেখান থেকে একদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর একদিকে তিস্তা ডুয়ার্স দেখতে পাওয়া যায়। সামথারের অন্যতম আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট স্পট পনবু। গাড়িতে যেতে লাগে মিনিট পনেরো। যাঁরা বেশি ঘোরাঘুরি পছন্দ করেন না, তাঁরা এখানে এসে নির্ভেজাল সময় কাটাতে পারেন।
চোখের সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা। নিদেনপক্ষে মেঘ বৃষ্টি ও কুয়াশার মজাও উপভোগ করতে পারেন। জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে পারেন সামথারের আনাচে কানাচে। শহুরে শব্দ থেকে চট করে প্রকৃতির কোলে সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে রেখে নিরিবিলিতে সময় কাটাতে পারেন। পাখির ডাক। সবচেয়ে মজার হল এখানে ঘুম ভাঙবে মুরগির ডাক শুনে। খুব একটা উঁচু না হওয়ায় বয়স্ক নাগরিকেরাও সামথারে চলে আসতে পারেন ছুটি কাটাতে।
পাহাড়ে ঘোরাঘুরির সূত্রে অনেক সময় দূর থেকে দেখেছি বিয়ে বাড়ি। কিন্তু কোনওদিন ঢুকতে পারিনি। এই গ্রামের মানুষ এতটাই অতিথিবত্সল যে, এই দফায় নিমন্ত্রণ জুটে গেল। গিয়ে দেখলাম কী সুন্দর অনাড়ম্বর বিয়ে বাড়িতে অতিথিরা আপন আনন্দে মশগুল হয়ে আছেন। খাওয়া, আড্ডা, গান, নাচ। কোথাও কোনও অতির গল্প নেই। সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে শুরু হল বৃষ্টি। রাতভোর চলা ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টিতে সকালের মুখ ভার।
এরপর বিদায়ের পালা। ব্যাগ গুছিয়ে এবারের মতো সামথারকে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়লাম শেয়ার গাড়িতে। হি হি ঠান্ডায় যখন গাড়ির ভিতর বসে কাঁপছি তখন সহযাত্রী এক ভদ্রলোক আমাকে এক গ্লাস গরম জল এগিয়ে দিলেন। ওই ঠান্ডায় সেই মুহূর্তে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়েছিল। অদেখা পনবু আর সামথার থেকে দেখতে পাওয়া কাঞ্চনজঙ্ঘাকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম।
যেতে আড়াই ঘণ্টা লাগলেও শেয়ার গাড়িতে প্রায় দেড় ঘণ্টায় শালুগড়া পৌঁছে গেলাম। ও হ্যাঁ, বলে রাখা ভালো যাঁরা শেয়ার গাড়িতে সামথার আসতে চান তাঁরা শালুগড়া শনি মন্দিরের সামনে থেকে গাড়ি পেয়ে যাবেন। ভাড়া মাথাপিছু ২৪০-২৫০ টাকা। এছাড়া এনজে পি থেকে ভাড়ার গাড়িতে সামথার যাওয়া যায়। থাকার জায়গা বলতে দু’-একটা হোম স্টে।