মস্কোতে প্রথম যখন পা রাখি, মফস্বল থেকে আসা কোন ব্যক্তি যেমন হা-করে ঢাকার শহর দেখে, আমি এখানে এসে দেখছিলাম মস্কোর অপ্সরাদের। পুরো মস্কো জুড়ে এতো অপ্সরা ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ কারো কোন মাথা ব্যথা নেই বা মাথা নষ্ট হচ্ছে না। সব স্বাভাবিক।
বলছিলাম রুশ নারীদের কথা।
সারা পৃথিবী ঘুরে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি, কিন্তু রাশিয়া এসে রাশিয়ান মেয়েদের দেখে আমি মুগ্ধ । তাদের চালচলনে, পোশাকে,ব্যক্তিত্বে, হাঁটা-চলায় সব কিছুর মধ্যেই একটা স্টাইল আছে।
মেরুদণ্ড টান টান করে হাতে ব্যাগ, কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে রুশ কন্যাদের হেঁটে চলা। মস্কোয় এই দৃশ্য এখানে রোজকার।
রাস্তা-ঘাটে,মেট্রোতে, বাসে, ক্যাম্পাসে, হোস্টেলে — সবখানেই দেখেছি এরা হেঁটে চলে নিজেদের মতো করে। কারো সাথে কোন ইন্টারেকশন নাই। মাঝেসাঝে আড় চোখে তাকায়।
এটাই এখানকার নিয়ম। অপরিচিত কারো সাথে সৌজন্যমূলক হাসি বা কথা নেই। কারণ তারা মনে করে, অপরিচিত কারো দিকে তাকিয়ে নাকি বোকারা হাসে। তারা মনে করে , হাসলে নাকি তারা মনে করে হাস্যজ্জ্বল মানুষটি হয় বোকা, নয় যাকে দেখে হাসি দিচ্ছে তাকে ব্যঙ্গ করছে। তারা কখনো অচেনা কাউকে দেখে হাসি দেয়না ।
স্বনির্ভর রুশ নারী
উনিশ শতকের কবি নিকোলাই নেক্রাসোভ একজন রুশ নারীর স্বনির্ভর এবং শক্তিশালী ইমেজ বোঝাতে বলেছিলেন, “একজন রুশ কন্যা দৌড়ানো ঘোড়া থামিয়ে দিয়ে জ্বলন্ত ঘরে প্রবেশ করতে পারে।”
রুশ নারী এতোটাই স্বাবলম্বী যার সত্যি কোন সাহায্য এবং প্রোটেকশন এর দরকার হয়না পুরুষের কাছে।
এদেশে নারীরা স্বনির্ভর প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে। পুরুষদের চাইতে এখানে নারীরাই বেশি কর্মঠ। পলিক্লিনিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমব্যাসিতে, ব্যাঙ্কে — বেশির ভাগ কর্মী নারী। এমনকি এখানে বাস-ট্রাক-কার নারীরাই চালায়।
তাহলে বুঝুন তাদের প্রভাব কতটুকু রাশিয়াতে।
রাশিয়ায় পুরুষের তুলনায় দুই কোটি বেশি নারী রয়েছে (অর্থাৎ, প্রতি ছয় জন পুরুষের বিপরীতে সাত জন নারী।) তবে এর পেছনে কারণও আছে । এর মুল কারণটি হল পুরুষরা নারীদের চেয়ে অনেক কম বয়সে মারা যান।
দেবুশকা আর বাবুশকা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পুরুষদের তুলনায় আরো অনেক নারী বেঁচে ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পুরুষদের মৃত্যুর ফলস্বরূপ, ১৯৪৬ সালে কর্মক্ষম বয়সী মহিলারা পুরুষের চেয়ে দুই কোটি বেড়েছে। আর এখানে তাই নারীদের প্রভাব বেশি।
‘দেবুশকা’ এবং ‘বাবুশকা’ এই দুটো বিশেষণে রুশ নারীদের ডাকা হয়। আমাদের দেশে নারী, মহিলা, কিশোরী, তরুণী যাই বলি না কেন। এদেশে সকল নারীদের ‘দেবুশকা’ বলা হয়। আর বুড়িদের ডাকা হয় ‘বাবুশকা’ (দিদিমা) বলে।
কিন্তু রুশ নারীরা বয়স বাড়লেও বুড়ি হতে চায়না। তাই অচেনা কোন বয়স্ক নারীকে আপনি বাবুশকা ডাকলেই বিপদ। রুশ ভাষায় আচ্ছা মতো আপনাকে ঝেড়ে দেবে। তারচে তাকে দেবুশকা ডাকবেন নিরাপদ থাকবেন।
ফলে ৭০ বছরের বুড়িদের চাইতে একটু কম বয়স্ক মহিলাও এখানে ‘দেবুশকা’ । আমাদের দেশে বুড়ি কেন নারীদের জন্যও বাসে সিট ছেড়ে না দিলে মহিলারা মাইন্ড করেন। আর এখানে উলটো।
আপনি যদি কোন নারীর জন্য সিট ছেড়ে তাকে বসার জন্য অফার দেন অনেক নারী মাইন্ড করেন। আর অনেকে বসবে ঠিকই, কিন্তু আবার বসতে বসতে ভাববে যে তাকে কি বুড়ি ভেবে বসতে দেয়া হলো!!
শিল্প সাহিত্যের দেশের রুশ কন্যারা ফুল ভালোবাসে। আর ভালোবাসে চকোলেট । রুশ কন্যাদের খুশি করতে চাইলে এই দুটো জিনিস অবশ্যই তাকে দেবেন। এমনকি কোন রুশ পরিবারে আপনি নিমন্ত্রিত হলেন অবশ্যই বাসার নারী আর বাচ্চার জন্য ফুল অথবা চকোলেট নিয়ে যেতে হবে। নইলে এরা অতিথিকে অসামাজিক ভাবে।
আর প্রিয়জনের জন্য ফুলের তোড়া কেনার আগে এটা মনে রাখতে হবে তারা কেবল অড নাম্বার অর্থাৎ বেজোড় সংখ্যক ফুল উপহার দেয়। তবে হলুদ ফুল ভুলেও দেবেন না। তারা মনে করে এটা বিচ্ছেদের লক্ষণ।
বন্ধু, প্রতিবেশী বা সহকর্মীদের নিমন্ত্রণে রাশিয়ানরা কখনই খালি হাতে যান না। চকোলেট বক্স, মদের বোতল, কেক অথবা ফুল নিয়ে যাওয়া রুশদের ট্র্যাডিশন। আর বাইরে কোথাও দেখা করলে ক্যাফে অথবা রেস্তোরাঁতে, সেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে খাবার বিলটা অবশ্যই পুরুষ দেবে। এটাই এখানকার রীতি।
মস্কোর নারী সৌন্দর্য সচেতন
মস্কোর নারীরা সৌন্দর্যের ব্যাপারে খুব সচেতন। তারা নিজেদের পরিপাটী ও পরিমার্জিত রাখতে ভালোবাসে । তারা নিজের আরামের চেয়ে স্মার্ট লাগাটা বেশি জরুরী মনে করে। হাই হিল পরা অসুবিধা বুঝেও তারা হাই হিল পরতে ভালোবাসে। অনেকে কর্মস্থলে এক ড্রেস দ্বিতীয়বার পরে না।
মস্কো শহর জুড়ে যেখানে সেখানে আছে ম্যানিকিউর-পেডিকিউর করবার স্যালুন। রুশ নারীরা হাত এবং পা-এর খুব যত্ন নেয়। তাদের কথা হচ্ছে, ‘যদি তুমি সুন্দর হয়ে থাকার সুযোগ পাও তাহলে কেন সেই অপশনটা বেছে নেবে না?’ তারা মনে করে, বিউটি ইজ পাওয়ার এন্ড রেসপেক্ট।
আবার অন্যদিকে রাশিয়ান নারীরা ন্যাগার (ঘ্যান ঘ্যান করা) এবং কমপ্লেইনার হিসেবে পরিচিত। মস্কোর মহিলাদের মাতাল হওয়ার জন্যও খ্যাতি রয়েছে। তবে উল্টোটাও আছে।
মস্কোর অনেক রুশ পরিবারে মেয়েদের সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হয়, তা না হলে মায়ের বকুনি খেতে হয়। আমার জানা এক মেয়ে দাশা, সে চাকরি করে পড়াশোনা করছে, কিন্তু বাসায় ফিরতে হয় রাত আটটার মধ্যে। এটাই পরিবারের নিয়ম।
শুধু দাশার পরিবারই নয়, এমন অনেক রক্ষণশীল পরিবার এখানেও আছে। সুতরাং আমরা যারা ভাবি যে বিদেশি মানেই যা ইচ্ছে তাই করে, সেটা ঠিক নয়। এখানে প্রচুর চার্চ রয়েছে। প্রতি শনি ও রবিবার চার্চ ভর্তি রাশান নারীদের প্রার্থনা করতে দেখা যায়।
রুশ কন্যারা খুব সেনসিটিভ। তারা প্রবল আবেগী। বাইরে থেকে বুঝার উপায় নেই। তারা চায় তার প্রেমিক পুরুষটি পৃথিবীর অন্য সব পুরুষের চাইতে আলাদা হবে। সম্ভবত সব চেয়ে প্রতিভাবান, সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বুদ্ধিমান।
প্রত্যেকটা রুশ কন্যা নিজেকে ভাবে রানীর মতো, যে কিনা বেছে নেবে এমন এক পুরুষকে যে তার স্বপ্নের পুরুষ, যে তাকে আগলে রাখবে, ভালবাসবে শ্রদ্ধা ও যত্ন করবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ সে নিজেকে মূল্যবান মনে করে ততোটাই।
একই সাথে তারা ডিমান্ডিং। কোন রুশ কন্যার মন জয় করতে চাইলে ঝাঁপিয়ে পড়ুন পানিতে পড়ে যাওয়া বিড়াল ছানাটিকে বাঁচাতে, কিংবা ক্ষুধার্ত কুকুরের হাত থেকে বাঁচান দুর্বল হাঁস ছানাটিকে অথবা বাসে কোন বৃদ্ধ লোকের জন্য নিজের সিটটি ছেঁড়ে দিন। মোট কথা ইমপ্রেস করা।
এটা সব দেশের নারীদেরই স্বপ্ন। তবে রুশ কন্যাদের সব কিছুতেই একটু বেশীই ডিম্যান্ড।
কিন্তু বাস্তবতা ঠিক তার উল্টোটাই।
‘চড় মারা স্বাভাবিক’
রাশান পুরুষরা ঠিক এর উল্টোটাই আশা করে। বেশিরভাগ রুশ পুরুষই মনে করে বউরা তাদের নির্যাতন সহ্য করবে, এটাই স্বাভাবিক। দস্তয়েভস্কি, চেখভ, এবং গোর্কির গল্পেও উল্লেখ আছে: একজন মহিলাকে চড় মারা স্বাভাবিক। এটি জীবনের অঙ্গ।
এখানকার জনগণ গৃহস্থালি সহিংসতাকে অপরাধ বলেই মনে করেনা। তারা মনে করে এটা সোশ্যাল নর্মস। আর সে কারণেই রাশিয়ার পুরুষদের পক্ষে মহিলাদের মারধর করা স্বাভাবিক ঘটনা।
ফলে ১৯৯৪ সালের আগে নির্যাতিতা মহিলাদের জন্য মস্কোতে কোন হটলাইন চালু হয়নি ।
একটু ধাক্কা খাওয়ার মতোই ঘটনা তাই না? আমারো মানতে কষ্ট হয়েছিল স্বনির্ভর আত্মনির্ভরশীল নারী হওয়া স্বত্বেও রুশ নারীদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে পুরুষ শাসিত সমাজ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, সমাজে রাশিয়ান নারীদের এত দাপুটে চলার আড়ালেও লুকিয়ে আছে অনেক কঠিন সত্য।
আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার মতো রাশিয়ার জীবনব্যবস্থাও পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নারীরা সামাজিকভাবে নির্ভরশীল।