বর্তমান সময়ে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় নিঃসন্দেহে করোনাভাইরাস। ঘরে-বাইরে সবখানেই এই ভাইরাসকে নিয়ে আতঙ্ক, এক অব্যক্ত আশঙ্কা খেলা করছে সবার চোখে-মুখে। এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত আর কোন ধরনের কাজকর্ম থেকে আমাদের বিরত থাকা উচিত তা নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক আর্টিকেল, ছবি ও ভিডিও দেখা হয়ে গেছে মানুষজনের। তাই সেটা নিয়ে নতুন করে কিছু বলতে এই লেখা না। বরং, একটু ভিন্ন কিছু খুঁজে দেখতেই এই লেখার অবতারণা।
কী সেই ভিন্ন জিনিস? এই যে নভেল করোনাভাইরাস নিয়ে এত আতঙ্ক, এর প্রথম রিপোর্টটি আসে গত বছরের ১৭ নভেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে। পরবর্তীতে সেখানে কীভাবে এই কভিড-১৯ অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে সেই তথ্য আমাদের সবারই জানা। মজার বিষয় হলো- সেই চীন কিন্তু এখন করোনাভাইরাসের ধাক্কা অনেকখানিই কাটিয়ে উঠেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে মাত্র ২২ জন নতুন করে আক্রান্ত হবার খবর পাওয়া গিয়েছে। যেখানে মাত্র কিছুদিন আগেও সপ্তাহে চীনে কয়েক হাজার করে মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছিল, সেখানে মাত্র অল্প কিছুদিনের ব্যবধানেই বিশাল এক উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে তারা। আর এর পেছনে যারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে, চীনের প্রযুক্তি বিষয়ক কোম্পানিগুলো তাদের মাঝে অন্যতম।
কীভাবে? সেটাই জানানো হবে আজকের এই লেখায়। বলা হবে কীভাবে চীনের টেক জায়ান্টরা স্বদেশের এই ভয়াবহ সময়ে জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। ০ আর ১ এর জাদুতে কীভাবে তারা প্রশমিত করতে পেরেছে করোনাভাইরাসের এই মহামারীকে।
চীনে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে এগিয়ে এসেছে টেনসেন্ট, বাইডু, আলিবাবাসহ আরও অনেকগুলো প্রযুক্তি বিষয়ক কোম্পানিই। তাদের এই এগিয়ে আসা একদিকে যেমন মানুষজনের সুস্বাস্থ্য ও সমাজের স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে, তেমনই নিজেদের এসব জনহিতকর কর্মকাণ্ডে দেশটির জনগণ ও সরকারের কাছে তাদের ভাবমূর্তিও অন্য স্তরে পৌঁছে গেছে। এই অন্য স্তরকে যদি মারভেলের অ্যাভেঞ্জারদের সাথে তুলনা করা হয়, তাহলে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। কারণ, সুপারহিরোদের মতো তারাও বিগ ডাটা, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ফাইভ-জির মতো প্রযুক্তিকে সুপার পাওয়ার হিসেবেই ব্যবহার করেছে।
এই যেমন চীনা মাল্টিন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি জেডটিই এর কথাই শুরুতে বলা যাক। তারা এগিয়ে এসেছে রিমোট ডায়াগনস্টিক সার্ভিস নিয়ে। সিচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েস্ট চায়না হসপিটাল এবং চেংডু পাবলিক হেলথ ক্লিনিক্যাল মেডিকেল সেন্টারে তারা নিয়ে এসেছে ফাইভ-জি ডায়াগনোসিস ও ট্রিটমেন্ট সার্ভিস। এর ফলে সংক্রমণের মাত্রা কমিয়ে আনা গিয়েছে বেশ ভালভাবেই।
ওদিকে জনসমাগম এড়াতে, মানুষে-মানুষে সংস্পর্শ এড়াতে প্রথাগত অফলাইন কনসাল্টেন্সির পরিবর্তে অনলাইন কনসাল্টেন্সি সার্ভিস চালু করেছে টেনসেন্ট, আলি হেলথ এবং পিং অ্যান গুড ডক্টর। এতে করে একদিকে যেমন মানুষজন ঘরে বসেই স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সেবা পেয়েছে, তেমনই রোধ করা গিয়েছে ভাইরাসটির বিস্তার।
এখন আবার চলছে বিগ ডাটার জয়জয়কার। চীনের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এই কভিড-১৯ ঠেকাতে এর সর্বোত্তম ব্যবহারই করছে। এর সাহায্যে পাবলিক এরিয়াগুলোতে তারা মানুষজনের উপর পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছে। এআই ফার্ম মেগভী এবং চীনা অনলাইন সার্চ জায়ান্ট বাইডু বেইজিংয়ের কিছু সাবওয়ে স্টেশনে দূরে থেকেই মানবদেহের তাপমাত্রা পরিমাপের ব্যবস্থা করেছে, যাতে করে যেসব যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, তাদেরকে সহজেই শনাক্ত করা যায়। এতে করে কম সময়ে, কম জনবল নিয়ে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করেই জনস্বাস্থ্যের পরীক্ষা করা হয়ে যাচ্ছে। বাইডু তো আরও একধাপ এগিয়ে এআই অ্যালগরিদমের সাহায্যে দ্রুততম সময়ে কারও দেহে উপসর্গ দেখা দেয়ার পর তিনি আসলেই করোনাভাইরাস কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছেন কি না সেটা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করেছে।
আলিবাবার রিসার্চ ইনস্টিটিউট ডামো অ্যাকাডেমি, ঝেজিয়াং প্রভিন্সিয়াল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন্স এবং জিয়েই বায়োটেকনোলজি কোম্পানি লিমিটেড মিলে গড়ে তুলেছে একটি হোল-জিনোম ডিটেকশন এন্ড অ্যানালাইসিস প্লাটফর্ম। এতে করে কারও আক্রান্ত হবার ব্যাপারে সন্দেহ হলেই দ্রুততা ও দক্ষতার সাথে সেটা নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে।
আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা তো দানশীলতার অসাধারণ এক নজির স্থাপন করেছেন। জ্যাক মা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনি ২.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (আনুমানিক ১৭ কোটি ৮০ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকা) অনুদানের ঘোষণা দিয়েছেন, যে অর্থের পুরোটাই ব্যয় করা হবে এই ভাইরাসটি ঠেকানোর ভ্যাকসিন তৈরি সংক্রান্ত গবেষণায়।
চীনের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় এআই ফার্ম সেন্সটাইমের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা বেইজিং, শাংহাই ও শেনঝেনের বিভিন্ন আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন, স্কুল ও কমিউনিটি সেন্টারে তাদের কন্টাক্টলেস টেম্পারেচার ডিটেকশন সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। চীনা সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমস জানিয়েছে, সিচুয়ান শহরের চেংডু শহরের করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নিয়োজিত কর্মীদের একধরনের স্মার্ট হেলমেট দেয়া হয়েছে, যা আশেপাশে ৫ মিটার ব্যাসার্ধের ভেতর যে কারও শরীরের তাপমাত্রা নির্ণয় করতে সক্ষম। এবং কারো যদি জ্বর থাকে, তাহলে সাথে সাথেই অ্যালার্ম বাজানো শুরু করে সেই হেলমেটটি!
করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে মানুষজনের সংস্পর্শ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে। আর এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে আইফ্লাইটেকের উদ্যোগে শুরু হয়েছে ‘AI Plus Office’ প্লাটফর্ম, যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানি সশরীরে অফিসে উপস্থিত না হয়েও অফিসের কাজ ঠিকই করে নিতে পারবেন। আবার অনলাইন এডুকেশন স্টার্টআপ জুওয়েবাং শুরু করেছে রিমোট এডুকেশন প্রোগ্রাম, যাতে করে এই সময়টাও ঘরে বসে নতুন কিছু শিখতে পারে মানুষ।
ইন্টেলিজেন্ট রবোট ফার্ম ক্লাউডমাইন্ডস নিয়ে এসেছে বেশ কিছু স্মার্ট রবোট, যারাও কি না এই কভিড-১৯ এর বিস্তার ঠেকাতেই কাজ করছে। এই রবোটগুলো আইসোলেশন ওয়ার্ডে সার্ভিস, ডেলিভারি সার্ভিস, হাসপাতাল পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্তকরণ এবং দূর থেকে মানবদেহের তাপমাত্রা নির্ণয়ে সাহায্য করছে।
ওদিকে ই-কমার্স জায়ান্ট জেডি, কুরিয়ার ফার্ম শুনফেং এক্সপ্রেস এবং অন্যান্য তাজা খাবার সরবরাহকারী অ্যাপগুলোও নিজেদের দেশের এই দুরবস্থায় এগিয়ে এসেছে। মানুষজন তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য জিনিসগুলো যেন দ্রুততম সময়ে পায় সেই বিষয়টি নিশ্চিত করে যাচ্ছে তারা।
যতই ভাইরাসের প্রকোপ থাকুক না কেন, মানুষজন অল্প সংখ্যায় হলেও ঠিকই কাজের জন্য ঘর থেকে বের হচ্ছে। এজন্য এই অবস্থায় ভাইরাসের বিস্তার রোধে ভূমিকা রাখতে হাতে থাকা স্মার্ট ফোনের অ্যাপগুলোই। আলিপে হেলথ কোড নামক অ্যাপটির কথাই ধরা যাক। এই অ্যাপে মানুষজনের শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী সবুজ, হলুদ বা লাল রঙ দেখায়, যাতে করে ব্যবহারকারী বুঝতে পারেন তার এখন ঘরের বাইরে বের হওয়া ঠিক হবে নাকি সবার কাছ থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখতে হবে। অ্যাপটির ডেভেলপার অ্যান্ট ফিনান্সিয়ালের দেয়া তথ্যমতে, এজন্য তারা বিগ ডাটার সাহায্য নিচ্ছেন। টেনসেন্টও কিউআর কোডভিত্তিক এমন একটি সেবা চালু করেছে। তাদের ‘ক্লোজ কন্টাক্ট ডিটেক্টর’ অ্যাপটি ব্যবহারকারীকে জানাচ্ছে যে তিনি ভাইরাসবাহী কারও কাছে গিয়েছেন কি না।
এভাবেই চীনের এই দুর্যোগকালে তাদের প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসার ফলে দ্রুততম সময়ে ও নির্ভুলতার সাথে কভিড-১৯ এর বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করা যাচ্ছে, মানুষজন ঘরে বসেই অফিসের কাজগুলো দক্ষতার সাথে এগিয়ে নিতে পেরেছে, যারা নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে চেয়েছে তারা ঘরে বসে অনলাইন এডুকেশন প্লাটফর্মের মাধ্যমে সেটা করতে পেরেছে, এবং কোনো রকম কেনাকাটার দরকার হলে সেটাও অনলাইন থেকেই সারতে পেরেছে।
মানুষজন আবার এবারের ঘটনা থেকে আরেকটি বড় ধরনের শিক্ষাও পেয়েছে। তারা যে কেবল স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছে তা-ই না, বরং প্রথাগত সমাজ ব্যবস্থা থেকে তারা নিজেদের অজান্তে এবং প্রয়োজনের তাগিদে তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাকে আগের চেয়ে আরও বেশিই কাছে টেনে নিয়েছে। ফলে একটি বিষয় দিনের আলোর মতোই সবার কাছে স্বচ্ছ হয়ে গিয়েছে যে, সামনের দিনগুলোতে এমন বিপদ মোকাবেলার জন্য সরকার, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে এসব প্রযুক্তির উত্তরোত্তর ব্যবহার নিশ্চিত করা ছাড়া আসলে উপায় নেই।
আমরা, এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইলের অধিবাসীরা, কি প্রস্তুত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে?