অসহায়: পারস্পরিক দূরত্বের বিধি মানে কে? গাজিয়াবাদের একটি বাস স্ট্যান্ডে আটকে পড়া ভিন্ রাজ্যের শ্রমিকদের ঠেলাঠেলি। ছবি: রয়টার্স।
ধৌলা কুঁয়ার গ্যারাজ লাগোয়া ঘর থেকে কাল মাঝরাতেই বেরিয়ে পড়েছিলেন বিপিন যাদব ও অজয় কুমার। গ্যারাজের মালিক বলে দিয়েছেন, এ মাসের মজুরি মিলবে কি না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এ দিকে পকেটে পয়সাও ফুরিয়ে এসেছে। পেট চলবে কী করে?
ব্যাগ কাঁধে হাঁটতে হাঁটতে ভোর রাতে দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ সীমানায় আনন্দ বিহার বাস টার্মিনাস। সেখানে হাজার হাজার লোকের জনসমুদ্র। বিপিন-অজয় ফিরবেন ফিরোজাবাদের গ্রামে। অনেকে ফিরবেন উত্তরপ্রদেশের অন্য কোথাও, অনেকে ফিরবেন বিহারে। মাঝে মাঝে বাস আসছে। তার ছাদ থেকে পা-দানি পর্যন্ত ঠাসা ভিড়। ২৪ নম্বর জাতীয় সড়কের দু’ধারে লম্বা লাইন।
কোথায় করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা, কোথায় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখায় নিয়ম? সন্ধেবেলাতেও আনন্দ বিহারে প্রায় ব্রিগেড সমাবেশের মতো থিকথিকে ভিড়। যা দেখে গোটা দেশ স্তম্ভিত, আতঙ্কিত।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লকডাউন ঘোষণা করার পরদিন থেকেই শ্রমিকদের ঘরে ফেরার মিছিল শুরু হয়েছিল। শুক্রবার অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় জানিয়ে দেয়, ঘরে ফেরানোর বন্দোবস্ত সরকার করবে না। কারণ তাতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। যে যেখানেই আছেন, সেখানেই থাকতে হবে। রাজ্যগুলি শ্রমিকদের আশ্রয়-খাবারের বন্দোবস্ত করবে।
কেন্দ্রের এই নির্দেশের উল্টো পথে হেঁটে শনিবার সকাল থেকে উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার হাজার খানেক রাজ্য পরিবহণের বাস রাস্তায় নামিয়েছে। দিল্লির সীমানা থেকে সেই সব বাসে করেই উত্তরপ্রদেশ-বিহারের শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যোগী সরকারের বক্তব্য, এ ছাড়া উপায় নেই। কারণ, বাস না পেয়ে শ্রমিকরা কয়েকশো কিলোমিটার হেঁটেই বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছেন। রাস্তায় খাবার-জল মিলছে না। ক্লান্ত হয়ে হাইওয়ের পাশেই শুয়ে পড়ছেন তাঁরা। পুলিশ নামিয়ে হাজার হাজার শ্রমিকদের রাস্তা আটকানো সম্ভব নয়। প্রাক্তন মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেনের আশঙ্কা, এ ভাবে চললে খাদ্যের জন্য দাঙ্গা লেগে যেতে পারে। অতীতে দুর্ভিক্ষের সময় এ দেশে তেমন ঘটেছে।
শেষ পর্যন্ত বেগতিক দেখে অমিত শাহ আজ বলেছেন, মোদী সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াবে। কী ভাবে? তাঁর জবাব, স্বরাষ্ট্রসচিব আজ রাজ্যগুলিকে চিঠি লিখে হাইওয়ের ধারে তাঁবু খাটিয়ে ত্রাণশিবির খুলতে বলেছেন। সেখানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা, প্রয়োজনে কোয়রান্টিন ও হাসপাতালে পাঠানোর বন্দোবস্তও রাখতে হবে। এ জন্য রাজ্যের দুর্যোগ মোকাবিলা তহবিল থেকে অর্থ খরচ করতে হবে। কিন্তু তাঁবুতে কী ভাবে শারীরিক দূরত্ব বা কোয়রান্টিনের ব্যবস্থা থাকবে, তার জবাব মেলেনি। কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী নিতিন গড়কড়ী জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে সক্রিয় হতে বলেছেন।
এই আতঙ্ক এবং অসহায়তার পরিস্থিতি তৈরি হতে দেওয়ার জন্য বিরোধীদের আঙুল মোদী সরকারের দিকে। রাহুল গাঁধীর অভিযোগ, নাগরিকদের এই দুর্দশার মুখে ঠেলে দেওয়া মস্ত অপরাধ। কংগ্রেস নেতা অজয় মাকেনের দাবি, মোদী সরকার লকডাউন ঘোষণা করেছে, কিন্তু তার জন্য কোনও পরিকল্পনা তৈরি করেনি। তাঁর প্রশ্ন, রাত ১২টা থেকে ২১ দিনের লকডাউনের ঘোষণা কেন রাত ৮টায় করলেন প্রধানমন্ত্রী? কেন আমজনতাকে প্রস্তুতি নেওয়ার সময় দেওয়া হল না? কেন শ্রমিকদের দুরবস্থা দেখেও কেন্দ্র তাদের জন্য নগদ অর্থসাহায্য, অন্য সুরাহার বন্দোবস্ত করল না? সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরির প্রশ্ন, মন্ত্রীরা কি শুধু দূরদর্শনে রামায়ণ-মহাভারত দেখার জন্য রয়েছেন?
কেন্দ্র এবং উত্তরপ্রদেশ সরকারকে তোপ দেগেছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারও। তাঁর যুক্তি, দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ হয়ে শ্রমিকরা বিহারে ফিরে এলে গোটা রাজ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে। কার মাধ্যমে কোথায় সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, তার হদিস মিলবে না। সকাল থেকে দিল্লির আনন্দ বিহারে কোনও শারীরিক পরীক্ষার বন্দোবস্তও ছিল না। দুপুরের পরে জ্বর মাপা শুরু হয়। শ্রমিকদের জন্য জল-খাবারের বন্দোবস্ত করতে দিল্লির উপ-মুখ্যমন্ত্রী মনীশ সিসৌদিয়া গাজিপুরে দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ গেটে যান। বিজেপির অমিত মালব্য আবার দিল্লি সরকারকে দায়ী করে অভিযোগ তুলেছেন, দিল্লি সরকার শ্রমিকদের ত্রাণের ব্যবস্থা করেনি বলেই তাঁরা ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন। বিজেপি নেতা বলবীর পুঞ্জের বক্তব্য, সব কিছুর জন্য শ্রমিকদের ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন মনোভাবই দায়ী। তাঁর যুক্তি, গ্রামে ফিরেও কোনও কাজ মিলবে না। আসলে ছুটি পেয়ে তাঁরা পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। করোনা-পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতেই পারেননি।