প্রথম দিন নিজের হাতে লতিকাকে সাজিয়ে দিয়েছেল নীলা। চোখে সামান্য কাজল, ছোট্ট টিপ আর একটু লিপস্টিকের ছোঁয়া, তাতেই কী সুন্দর লাগছিল মাজা রঙের মেয়েটাকে!
লতিকা মাহাতো এবং নীলা দত্তর মধ্যে এত গলায় গলায় বন্ধুত্ব কীভাবে সম্ভব হয়, সেটা অনেকের কাছেই একটা ধাঁধা। এই মেদিনীপুর হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে ওদের দু’জনকে বাদ দিয়ে নার্স, আরএমও, টেকনিশিয়ান মিলিয়ে সাকুল্যে আঠাশজন। তারা তো এই নিয়ে আলোচনা করেই, তা ছাড়াও এখানে নিয়মিত কেস করতে আসা ডাক্তারবাবুদের কাছেও ব্যাপারটা গবেষণার বিষয়। গাইনিকলজিস্ট ডা. মিত্র তো একবার সুবল সাহাকে জিজ্ঞাসা করেই বসেছিলেন, ‘‘ব্যাপারটা কী? লেসবিয়ান নয়তো?’’ সুবল সাহা মালিক পক্ষের প্রতিনিধি, পদাধিকারবলে ম্যানেজিং ডিরেক্টর। তবে তাকে জিজ্ঞাসা করাটা সেই কারণে নয়, একেবারে ঘোড়ার মুখ থেকে খবর পাওয়ার জন্য। নামে ফ্রন্ট ডেস্ক স্টাফ হলেও নীলা দত্ত যে সেই সঙ্গে সুবল সাহার রক্ষিতা, এ খবরে কোনও রাখঢাক নেই। সাহাবাবুকে দুর্জনে বলে হুলো। একটি মেনিতে তার পোষায় না। নীলা দত্তকে বছর তিনেক আগে নিয়ে আসার সময়ে সবরকম কর্তব্য-কর্ম বুঝিয়ে, দরদস্তুর করেই এনেছিল সে। মজার ব্যাপার হল, নীলারও এই নিয়ে কোনও লুকোছাপা নেই। “বাইরে ‘সতীপনা’ দেখিয়ে পরদার আড়ালে ছেনালি আমার বাপু দু’চক্ষের বিষ।” নার্সিংহোম থেকে ও মাইনে পায় দশ হাজার। থাকার ঘর আর ক্যান্টিনের খাওয়া ফ্রি। সুবলচন্দ্র সংসারী লোক, চন্দ্রকোনা রোড থেকে যাতায়াত করে। সপ্তাহে একদিন কি বড়জোর দু’দিন কাজের চাপের অজুহাতে এখানেই থেকে যায়। তার জন্য নীলা পায় আরও ছ’হাজার। মাসকাবারি হিসেব। এ ছাড়া বাহারি মোবাইল সেট, শাড়ি, ন’মাসে-ছ’মাসে ছোটখাটো গয়না — এসব তো আছেই। মোটামুটি নীলার নিজের ভাষাতেই, ও খুব একটা ‘লোকসানে নেই’। এহেন নীলা দত্তর সঙ্গে লতিকা মাহাতোর গলাগলি দোস্তিতে নার্সিংহোমের অন্য সবাই অবাক হবে বই কী!
হ্যাঁ, নার্সিংহোমই। নামে হাসপাতাল, রিসার্চ সেন্টার ইত্যাদি গালভরা বুলি থাকলেও আদতে এটা একটা নার্সিংহোম। কলকাত্তাইয়া কায়দা মফস্বলও রপ্ত করে নিয়েছে।
লতিকা এখানে এসেছে চার বছর হতে চলল। যখন এই নার্সিংহোম নাম বদলে ভারিক্কি হল, পনেরো বেড থেকে তিরিশ বেডের হল, ততদিনে ওর ডা. সৃষ্টিধর মান্ডির চেম্বারে আট বছর কাজ করা হয়ে গেছে। সৃষ্টিধর দিগ্বিজয়ী ডাক্তার। ডিগ্রিতে শুধু এমবিবিএস হলে কী হবে, চেম্বারের পিছনে দশ বাই বারো কুঠুরিতে লোহার টেবলের উপর দুশো পাওয়ারের ল্যাম্প লাগিয়ে যাবতীয় অ্যাবরশন, অ্যাপেনডিক্স, হার্নিয়া — বেমালুম নামিয়ে দিত। লতিকা ছিল ওর ডান হাত। চন্দ্রকোনা রোডে সুবল সাহার বাড়ির পিছনেই লতিকাদের মাটির দোচালা। জহুরির চোখ, সুবল ওকে ঠিক চিনেছিল। ক্লাস টেন অবধি পড়া লতিকার সেই অর্থে কোনও নার্সিং ট্রেনিং না থাকলেও ও যে কাজেকর্মে অনেকের চেয়ে দড়, সেটা বুঝে নিতে অসুবিধে হয়নি। সৃষ্টিধরের কাছে লতিকা কাজে ঢুকেছিল ‘পেটভাতের’ চুক্তিতে, মাসে তিনশো টাকা হাতখরচ। আট বছরের মাথায় থাকা-খাওয়া ফ্রি ছাড়াও ওর মাস-মাইনে চার হাজার। কিন্তু ডাবল মাইনের টোপেও যখন লতিকা রাজি হল না, তখন সুবল ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বসল। দুই দাদার কোলে ছোট বোন। বাপ মারা যাওয়ার পর পড়াশোনা বন্ধ হয়েছিল মেয়েটার। বড়দা তখন বিয়ে করে বাচ্চার বাপ, ছোড়দা উড়ছে।
বছর ঘুরতে না ঘুরতে সেও বাড়িতে বউ নিয়ে এসে তুলল। এদিকে বাপ যাওয়ার দু’মাসের মধ্যে মেয়েটা মান্ডির চেম্বারে চাকরি নিয়েছে। এর মধ্যে কেমন একটা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না? নিতে হবে, খবর নিতে হবে। সুবলের শোওয়ার ঘরেই তো নিউজ় এজেন্সি বসে আছে! কিন্তু লতিকারই বা কীসের এত আঠা, যে সৃষ্টিধরের কাজ ছাড়তে চায় না? কোন ইন্টুমিন্টু নেই তো ওর সঙ্গে? যাহ্, সবাইকে নিজের মতো ভাবলে চলে? সেরকম কিছু হলে ঠিক ওর কাছে খবর আসত।
গিন্নির কাছে বিশদ সংবাদ পাওয়া গেল। সুবল সাহা যা ভেবেছিল, তা-ই। ওদের মা সুবলদের বাড়ি মুড়ি দেয়। তার ইনিয়ে বিনিয়ে বলা দুঃখের কথা…আর বাড়ির কাজের মেয়ে, বাগালদের কাছ থেকে জোগাড় করা খবর মিলিয়ে সুবল-গিন্নী পুরো একটা গল্পই শুনিয়ে দিল। ছেলেদুটো নাকি পাষণ্ড, বউগুলো আরও এক কাঠি উপরে। মাকে ঘরে-বাইরে খাটায়, বোনের মাইনের টাকায় ভাগ বসায়। লতিকা মেয়েটা আবার ভাইপো-ভাইঝি অন্তপ্রাণ, তাদেরও ভিড়িয়ে দেয় পিসির কাছে, বায়না করার জন্য। শুষছে, ওরা শুষছে মেয়েটাকে। বিয়ে দেওয়ার কোনও চেষ্টাই নেই। বার কয়েক মেয়ে দেখানো হয়েছিল, নানা অজুহাতে ভেস্তে গেছে। বোন এখন ভাল রোজগার করে…‘দুধেল গাই’ হাতছাড়া করে কেউ? অতএব প্ল্যান ছকে নিল সুবল সাহা এবং এক চালেই বাজিমাত করল। বোনের রোজগার ডাবল হলে যে ওদেরই লাভ, সেটা বোঝাতে বেশি কষ্ট হওয়ার কথা নয়…‘‘আপনি নিজের দাদার থেকেও বেশি, আপনার ভরসায় পাঠাচ্ছি…আদরের ছোট বোন আমাদের…দেখবেন। এই তো এইটুকু রাস্তা, সপ্তাহ- দু’সপ্তাহ অন্তর বাড়ি আসবে তো বোনটা আমাদের?’’ মা-বোনের সামনে হেব্বি নাটক করল দু’ভাই। কিন্তু তাতেই শেষ নয়। আলাদা করে দু’জনকে দশ-দশ হাজার দিতে হয়েছিল সুবলকে। হোক। আলুর ব্যবসাটাও করে ও। দাদন দিয়ে রাখলে যে লাভ বেশি, সে কথা ওর থেকে ভাল আর কে জানে?
সেই দাদন এখন ফল দিচ্ছে। নার্সিংহোম যে পঞ্চাশ বেডের হয়েছে, তার অনেকটা কেরামতিই লতিকার। সুবল হিরে চিনতে ভুল করেনি। লতিকা ‘ওটি সিস্টার’। মেডিক্যাল কলেজের আচ্ছা আচ্ছা সার্জেনও এসে বলে যায়, হাউজ়স্টাফ নিয়ে অপারেশন করার থেকে লতিকাকে নিয়ে করা ঢের স্বস্তির। অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ও ঢের ভাল। কেস করে নিশ্চিন্তে বাড়ি যাওয়া যায়। পোস্ট-অপ দেখভালটাও ও ভাল করে। ডাক্তাররা যেটা বলে না, তা হল — লতিকাকে পঞ্চাশ-একশো টাকা বকশিস দিলেই ও খুশি। হাউজ়স্টাফ, পিজিটি সহকারী নিলে মোটা আ্যসিস্ট্যান্ট ফি দিতে হত। সস্তায় কেস করার লোভে ডাক্তাররা এখানে ভিড় জমাচ্ছে। মেদিনীপুর হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের এখন রমরমা। লতিকার মাইনে বেড়ে এখন হয়েছে বারো। আরও হাজার তিন-চার হয়ে যায় ডাক্তারদের থেকে। সেদিক দিয়ে খুব একটা মন্দ নেই ও। তবে ওর মতো বত্রিশ বছরের আরও পাঁচটা বিয়ে-না-হওয়া মেয়ের যা হয়, ওরও তাই হয়েছে, বড় দুর্মুখ হয়ে গেছে লতিকা আজকাল। নার্সিংহোমের কোনও মেয়ের প্রেম-ভালবাসার মুখরোচক খবর নিয়ে অন্যরা যখন রসিয়ে আলোচনা করে, তখন লতিকা দুম করে কোন কটু মন্তব্য করে বসবেই। গভীরে লুকোনো এক গোপন ঈর্ষাবোধ থেকেই যে এমনটা হয়, তা বুঝতে মনস্তাত্বিক হওয়ার দরকার নেই।
তবু অন্যরা একটা অলিখিত নিয়ম মেনে চলে। লতিকা মাহাতো অর নীলা দত্তকে কেউ ঘাঁটায় না। দুটি ভিন্ন কারণে ওরা মালিকপক্ষের একেবারে পেয়ারের লোক। তবে যে আলোচনাটা তাদের মধ্যে হয়ই, তা হল — লতিকা আর নীলা এত বন্ধু হয় কী করে? যে লতিকা মেয়েদের সততা আর সতীত্ব নিয়ে এত ছুঁৎমার্গী, সে যে কী করে নীলার ঢাক পিটিয়ে শরীর খাটিয়ে রোজগার করাটাকে মেনে নেয়, তার ব্যাখ্যা ওরা খুঁজে পায় না।
মানুষের মনের সব রহস্য কি অত সহজে বোঝা যায়? বেহালার একটা তারে ছড় ঘষলে অন্য এক তার কেন আপনাআপনি কাঁপতে থাকে, তার ব্যাখ্যা কি জানে ওরা? নীলা লতিকাকে ওর গল্প বলেছে। তেইশ বছরে বিয়ে, চব্বিশে ছেলে বাবাইয়ের জন্ম, তার আগে থেকেই বাপের বাড়ির আশ্রয়ে, পঁচিশে তো পাকাপাকি বিধবা। নীলা স্বামী শব্দটা ব্যবহার করে না। বলে, “আমার সঙ্গে যার বিয়ে হয়েছিল…লোকটা ছিল চূড়ান্ত ড্রাগ অ্যাডিক্ট। কীসব ইনজেকশন নিত শরীরে, পুরিয়া খেত, রাংতায় আগুন দিয়ে ধোঁয়া টানত, আর সারাদিন ঝিমোতো। জানিস, ওকে আমি টিকটিকির ল্যাজ পুড়িয়ে খেতে দেখেছি!’’ নীলার দাদা ডিভোর্সের মামলার তোড়জোড় করছিল। তখনই জানা গেছিল, লিভার গেছে, কিডনিদুটোও কাজ বন্ধ করছে…শরীরে আর কিছু নেই নেশাড়ুটার। বছর খানেক হাসপাতাল-বাড়ি করতে করতে অবশেষে মরল সে। দাদা বলেছিল, ‘‘ভুলে যা। ফের বিয়ে দেব তোর।’’ সময় পেল না। রানিগঞ্জের কনস্ট্রাকশন সাইটে ডাম্পার চাপা দিল দাদাকে। অ্যাক্সিডেন্ট! কেউ কেউ আবার সন্দেহ করে খুন। তা সে যাই হোক, সেটা নিয়ে তদন্ত করার মতো অর্থবল বা লোকবল, কোনওটাই নীলার ছিল না। দাদার ব্যবসার দখল নিল তার পার্টনাররা। আর ক্যাশ, ইনশিওরেন্স, যা কিছু ছিল, নিল বউদি। নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল। নীলার রইল তিন কামরার বাড়িটা, বুড়ো বাবা-মা এবং ছেলে বাবাইয়ের দায়দায়িত্ব। বুড়োবুড়ি যদ্দিন বাঁচে, তাদের দু’মুঠো অন্নসংস্থান করলেই চলবে, কিন্তু বাবাইকে যে মানুষ করতে হবে! আসানসোলের এক নার্সিংহোমে রিসেপশনিস্টের চাকরি পেল নীলা। মাইনে দু’হাজার। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট না করা মেয়ে এর বেশি কী আশা করতে পারে? নেহাত ইংলিশ মিডিয়ামের পালিশটা ছিল, তাই রক্ষে। কিন্তু প্রয়োজন যে অনেক বেশি! বাবাই স্কুলে গেলে খরচ সামলাবে কে? চটকদার চেহারা আর চালচলনের একটা মেয়ের এই বিপদে ছোটখাটো সাহায্য করার লোকের অভাব হল না। হালকা শরীর ঘষাঘষি দিয়ে শুরু করে মাঝেসাঝে দিঘায় উইকএন্ড…অনিয়মিত হলেও রোজগার মন্দ ছিল না। কিন্তু ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করার পর থেকেই দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছিল নীলার। রানিগঞ্জ–আসানসোল বড় কাছাকাছি জায়গা। একটা মৃদু ফিসফাস শুরু হয়ে গেছিল। ছেলে বড় হচ্ছে। অতএব পাকাপাকি ব্যবস্থা করে মেদিনীপুর এসেছে নীলা। বাবাই হস্টেলে। দু’সপ্তাহ অন্তর ‘কোম্পানির’ অর্থাৎ সুবলের গাড়িতে বাড়ি যায় নীলা।
দাদা ওভাবে মারা যাওয়ার পর বাবার স্ট্রোক হয়েছিল। এখনও শয্যাশায়ী। যে কোনওদিন চলে যাবে। ‘‘বাবাকে বলিনি। কিন্তু মা সব জানে। জানিস, মা’র সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলাই ওকে। ঢ্যামনাটা তখন আমার মাকে ‘ম্যা’ বলে ডাকে! আর, তোকে তো বলাই হয়নি, ওইসব সময়ে আমি ইংরিজিতে কথা বললে খুব নাকি জোশ বাড়ে ওর….হিহি। হ্যাঁ রে, ওর বউটাকে তো তুই চিনিস…একেবারে গাঁইয়া? অঙ্গুঠা ছাপ? ও ব্যাটা নিজেও তো শুনি উচ্চমাধ্যমিক ধপাস!’’ এমন সব কথা অত্যন্ত নির্লিপ্ত ভাবে হাসতে হাসতে বলে নীলা।
লতিকা অবাক হয়ে নীলার এইসব কথা শোনে। শুনতে শুনতে নিজের বাড়ির গল্পও করে বই কী। ভাইঝি যে মোবাইল কিনতে নাছোড়বান্দা, ভাইপোটা যে সাইকেলের বায়না জুড়েছে, সে গল্পও করে। ওদের মাটির দোচালার গায়েই যে দু’কামরার পাকা ঘর উঠছে, আর তার টাকার জোগান যে লতিকাই দিচ্ছে, সে কথাও তো কথায় কথায় বলে ফেলেছে ও। কিন্তু ওই পর্যন্তই। নীলা যখন ওকে ঠারেঠোরে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে বলে, নিজের নামে একটা রেকারিং ডিপোজ়িট করার প্রস্তাব দেয় কিংবা নিজেই দেখেশুনে প্রেম করে একটা বিয়ে করে নিতে বলে, লতিকা এমনভাবে বলে ‘যাহ্,’ যে আর কথা বাড়ানো যায় না। লতিকার মনের নিজস্ব কুঠুরিটার দরজা তখন বন্ধ হয়ে যায়। নীলারও সেখানে ঢোকার অনুমতি নেই। তবু ওরা বন্ধু, অন্যরা যতই অবাক হোক না কেন।
২
মুখে কিছু না বলুক, মনের মুখে কি হাত চাপা দেওয়া যায়? প্রেমপিরিতের সাধ, একটা পুরুষমানুষের বুকে নিজেকে ডুবিয়ে দেওয়ার বাসনা কি ওর মনেও আসে না? লতিকার কথা ভাবতে বসলে এমন চিন্তাই ঘুরপাক খায় নীলার মাথায়। তেমন যদি একটা মানুষ জুটে যেত, তা হলে দেখা যেত কী করে লতিকা তাকে এড়িয়ে থাকে। কিন্তু তার সুযোগ কই? নার্সিংহোমে সেরকম কোনও ব্যাটাছেলে নেই। কোনও পেশেন্ট পার্টির সঙ্গে যে একটা সম্বন্ধ গড়ে উঠবে, তারও তো সুযোগ নেই। লতিকার যত কাজ, সব ওটি-র গুহায়, বাইরের কারওর সঙ্গে ওর যোগাযোগের প্রয়োজন বা সুযোগ, কোনওটাই হয় না। হ্যাঁ, ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে ভালই মেলামেশা হয় ওর, কিন্তু তারা অনেক উপরের তলার মানুষ। পাশ করা নার্স হলেও চলে যেত, তাই বলে ঘষেমেজে কাজ শেখা লতিকা! সরকারি নিরিখে ও তো একটা উন্নত শ্রেণির আয়া বই কিছু নয়! আর জাত? মাহাতোরা জাতে কী? ঠিকঠাক জানে না নীলা, তবে বলার মতো কিছু যে নয় তা বেশ জানে।
এমনিতে নীলা নিজে জাতপাতে বিশ্বাস করে না, অথচ কী করে যেন এসব কথা কুলীন কায়স্থের মেয়ে, ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়া, বিএ সেকেন্ড ইয়ার ড্রপআউট নীলা দত্তর মাথায় এসেই যায়। ভাবনাগুলো নিজের মনে ঝালাই করার পর নীলা নিজেকেই বলে, ‘‘ছিঃ।’’
তবু এমনই অসম্ভব কিছু একটা ঘটে যাওয়ার আঁচ টের পাচ্ছিল নীলা। মাস কয়েক হল দারুণ এক সার্জন এসেছে মেডিক্যাল কলেজে, এবং যথারীতি তাকে পাকড়াও করেছে সুবল সাহা। অবশ্য একে পাকড়াও বলাটা অন্যায়। এই তল্লাটে ওটি-র ব্যবস্থা এখানকার মতো ভাল আর কোথাও নেই। তার উপর লতিকার মতো অ্যাসিস্ট্যান্ট, সস্তায় পুষ্টিকর! ডাক্তাররা আসতে বাধ্য। এই নতুন সার্জন, ডা. দীপক আচার্যও ব্যতিক্রম নয়। লতিকার প্রশংসায় সে পঞ্চমুখ। সেটা তো হতেই পারে, কিন্তু যেটা নতুন ঠেকছে নীলার কানে, তা হল — লতিকাও যেন ডা. আচার্যর কথা একটু বেশি বেশিই বলছে। ওটি কমপ্লেক্সের চায়ের ঘরে কাজের ফাঁকে যে আড্ডা বসে, সেটা এতদিন লতিকা এড়িয়েই চলত। কেজো মেয়ে, অন্যদের আড্ডার সময়ে ও পরের অপারেশনের টেবল সাজাতো। আশ্চর্য, ইদানীং ও চায়ের ঘরের গল্প বলতে শুরু করেছে! এসব কীসের লক্ষণ বাপু?
এমনিতে ডাক্তার লোকটাকে ভালই মনে হয় নীলার। বেশ হাসিখুশি, হুল্লোড়ে। ওদের রানিগঞ্জের হিন্দি ঘেঁষা বাংলায় যাকে ‘মজাকিয়া’ বলে, সেইরকম। কিন্তু লতিকা সেদিন অন্য কথা বলল। ‘‘কাউকে বলিস না, মানুষটা খুব দুঃখী রে। বউয়ের সঙ্গে বনে না। সে নাকি বিরাট বড়লোকের মেয়ে, স্বামীর ঘর ছেড়ে বাপের বাড়ি কলকাতায় থাকে। একমাত্র মেয়েটাকেও নাকি ওখানেই স্কুলে ভর্তি করেছে। বাপ মাসে মাসে হিন্দমোটর থেকে ঢাকুরিয়া যায় মেয়েকে দেখতে। বেচারা।’’ কথাগুলো শুনে নীলার মুখে মুচকি হাসি ছাড়া আর কিছু ফুটল না। দুঃখী কে নয় রে, অ্যাঁ? এদিকে তো বলছে বউ বড়লোকের মেয়ে। তার মানে নির্ঘাৎ পয়সার লোভে বিয়ে করেছিল বাপধন। তখন খেয়াল ছিল না? এখন একলা শোওয়ার গপ্পো শোনাতে বসেছে! কিন্তু লতিকার কাছে এসব দুঃখ করার মানে তো একটাই হয়! লাগ লাগ লাগ, লাগিয়ে দাও। হে বাবা কামদেব, দেখাও দেখি তোমার খেল। সত্যিকারের দুঃখী যদি কেউ থাকে, তবে সে এই মেয়েটাই ।
লতিকার মনে যে ডাক্তারের জন্য বেশ নরম একটা জায়গা তৈরি হয়েছে, তা বুঝে নিতে নীলার অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ডাক্তারের মতিগতিটাও বোঝা দরকার। সমস্যা হল, নীলা রিসেপশনে থাকে। ওটি কমপ্লেক্সে ওদের চায়ের আসরে ওর যাওয়াটা বেমানান। আহা রে, ওদের যদি বাইরে কোথাও বেশ কিছুক্ষণের জন্য একসঙ্গে পাওয়া যেত, তা হলে ওদের চোখের ভাষা থেকেই যা বোঝার বুঝে নিত নীলা।
প্রার্থনা কখনও কখনও পূরণ হয় বই কী। অভাবিত ভাবে নয়, খুব স্বাভাবিক কার্য-কারণ যোগেই সুযোগ এসে গেল নীলার সামনে। বছরের শেষ দিন নার্সিংহোম থেকে একটা পিকনিকের আয়োজন করাটা ওদের রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। খরচ সব ম্যানেজমেন্টের। সব স্টাফ তো বটেই, এখানে কাজ করা ডাক্তাররাও থাকেন বিশেষভাবে নিমন্ত্রিত। আসলে তাঁদেরই একটু রসেবশে রাখতে এই বিশেষ আয়োজন। তাঁরাও কেউ এ সুযোগ নেহাত বিশেষ অসুবিধে না থাকলে ছাড়েন না। তা হলেও ভাগ্যের হাতে কিছু ছাড়তে রাজি ছিল না নীলা। লতিকাকে পাখিপড়া পড়িয়ে ডা. আচার্যকে পিকনিকে যাওয়ার কথা বিশেষভাবে বলতে বলেছে। নিজেও সুবল সাহার কাছে কায়দা করে খোঁজ নিয়েছে। দু’জায়গা থেকে ‘হ্যাঁ’ শুনেও আঁচলে গিঁট দিচ্ছিল নীলা। না আঁচালে বিশ্বাস নেই।
৩
মেদিনীপুর শহর থেকে একটু বেরিয়েই রাঙামাটির রাস্তায় ইদানীং একটা ইকোপার্ক হয়েছে। দারুণ পিকনিক স্পট। সকাল ন’টায় ওদের বাস পৌঁছল সেখানে। কেটারিংয়ের দল আগেই হাজির হয়ে গেছে। বাসে শুধু নার্সিংহোমের স্টাফ। ডাক্তাররা আসবে সুবল সাহার সঙ্গে গাড়িতে। বলতে বলতেই এসে পড়ল তারাও। দুটো এসইউভি বোঝাই ন’জন ডাক্তার আর সাহা নিজে। নীলা লতিকাকে কনুইয়ের ঠেলা দিল, ‘‘তোর দুঃখী ডাক্তারবাবু এসেছে রে।’’ লতিকার মুখে যে আলো ছড়াল, চোখের পাতা কাঁপল যেমন করে, ডাক্তারেরও কি তেমনই হবে ওকে দেখে?
সবাই হাসিখুশি, সবাই হইহই করছে। কাগজের ঠোঙায় মুড়ি আর গরম গরম আলুর চপ বিলি হচ্ছিল জলখাবার হিসেবে। তাই দেখে কপট রাগে চেঁচিয়ে উঠল দীপক আচার্য, ‘‘ইয়ার্কি হচ্ছে? গাড়িতে এতজনকে মুড়ির টিনের মতো ঠেসে নিয়ে এলেন, এখন আবার জলখাবারে মুড়ি? নেহি খাউঙ্গা…এই যে সুবলবাবু, এমন মেঘলা শীতের সকাল, নিজের জন্য তো বেশ নারকেল-মুড়ির ব্যবস্থা রেখেছেন, আমরা কি আঁটি চুষব? হুইস্কি লে আও। নগদ পয়সার কেস ছেড়ে এসেছি, আজ সুবহ সে দারু পিউঙ্গা।’’ তার কথার শেষে নীলার দিকে তাকিয়ে কেন যে কয়েকজন ডাক্তার হেসে উঠল, নীলা তখন বোঝেনি। বোঝেনি সুবল সাহাও। সে বলল, ‘‘হচ্ছে, হচ্ছে। মাছভাজা আর হুইস্কি তো আছেই, যত চাই। কিন্তু আমি নারকেল-মুড়ি খাব মানে?’’ ফের হো হো করে হেসে উঠল ওরা ক’জন। নীলা আর লতিকা পাশেই দাঁড়িয়ে। যেন ওদের শোনাতে চায় না, এমনভাবে সুবল সাহার কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রায় সক্কলকে শুনিয়ে দীপক আচার্য বলল, ‘‘সে কি দাদা! ডুবে ডুবে জল খান, আর এটা জানেন না? নারকেল-মুড়ি মানে হল নারীকে কোলে নিয়ে মুড়ি দেওয়া!’’
তেমন তেমন পরিবেশে ডাক্তারদের মুখ যে কী হতে পারে তা ওরা ভালই জানে। এ তো সবে শুরু। এর পরে পেটে দু’পাত্তর পড়লে আর কাউকে রেয়াত করবে না ওরা। লতিকা আর নীলা সরে এল।
একটা ঝুপসি বকুলগাছের তলায় ডাক্তাররা শতরঞ্চি পেতেছে। সঙ্গে অবশ্যই সুবল সাহা। তিনতাস শুরু হয়েছে ওখানে। ওদের থেকে বেশ খানিকটা তফাত রেখে নার্সিংহোমের পুরো দলটা। হাসি, মশকরা, হুল্লোড় চলছে। ল্যাব টেকনিশিয়ান বিশু আর অভি জুনিয়র দুটো মেয়ের সঙ্গে খুনসুটিতে ব্যস্ত। লতিকা বলল, ‘‘দেখেছিস, চান্স পেয়েছে আর লেগে পড়েছে।’’ ওর গলায় রাগ নয়, কেমন যেন প্রশ্রয়ের সুর। নীলা হাসল। মনে মনে বলল, ‘চান্সটা তুইও নষ্ট করিস না মাইরি!’ সবাই বসে, এমনকী এক্স-রে’র মল্লিকদাও গুটিকয়েক মেয়ের মধ্যমণি হয়ে মজায় মজেছেন, শুধু ওরা দু’জন দাঁড়িয়ে। আয়ুর্বেদে এমবিবিএস করা চৈতালি ঘোষ ওদের আরএমও। পারতপক্ষে সে ডাক্তারদের কাছে ঘেঁষে না। চৈতালি ডাকল, ‘‘এস নীলাদি বসে পড়ো।’’ ওরা বসতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক তক্ষুণি সুবল সাহা হাঁক পাড়ল, ‘‘নীলি, শিগগির এদিকে মাছভাজা পাঠানোর ব্যবস্থা করো। নইলে স্যরেরা আমায় মেরে ফেলছে। ফার্স্ট রাউন্ড হুইস্কি শেষ হতে চলল, এখনও মাছের দেখা নেই!’’ অন্যরা চোখে চোখে চাইল। নীলা লতিকাকে বলল, ‘‘আয়, রান্নার ওদিকটা দেখি।’’
একটা ট্রে-তে স্তূপাকার তোপসে ফ্রাই, একতাড়া কাগজের প্লেট আর একটা কাসুন্দির শিশি নিয়ে বকুলতলায় হাজির হল ওরা দু’জন। দেখামাত্র হইহই করে উঠল সবাই। ডা. বন্দ্যোপাধ্যায় ফুট কাটলেন, ‘‘জয় হোক। অন্য কিছুর মাপ জানি না, কিন্তু আপনারা যাই বলুন, সাহাবাবুর মনটা বেশ বড়।’’ ফের একচোট খিকখিক হাসি। কথাবার্তা অন্যদিকে গড়াচ্ছে। নীলা বলল, ‘‘আমরা আসি। মাছ ফুরিয়ে গেলে হাঁক পাড়বেন।’’ বাধা দিল স্বয়ং সুবল সাহা, ‘‘যাবে? তার আগে আমার তাসটা একটু ছুঁয়ে দিয়ে যাও দেখি। স্যরেরা একা পেয়ে আমায় বেদম পিটছে।’’ সপ্রতিভ নীলা সাহার তাসে হাত ছুঁইয়ে বলল, ‘‘দেখব?’’
‘‘না না, ব্লাইন্ড চলছে, ব্লাইন্ড।’’ দীপক আচার্য হঠাৎ হইহই করে উঠল, ‘‘আনডিউ আ্যাডভান্টেজ নেওয়া চলবে না। এই যে লতিকা…এস তো, আমার তাসটা ছুঁয়ে দাও দেখি তুমি, তারপর দেখি কার কত হিম্মত! বিব্রত লতিকা কোনওমতে তাস তিনটে ছুঁল, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে নীলার হাত ধরে টানল, ‘‘চল।’’ আচার্য হাঁকল, ‘‘আমার দশ টাকা ব্লাইন্ড।’’ নীলা ধন্দে পড়ে যাচ্ছিল। সবার সামনে ওইভাবে তাস ছুঁতে বলা কি নেহাতই রগড়, না কোন দুঃসাহসী প্রকাশ্য ইঙ্গিত?
দুপুরের খাওয়ার পর সবাই একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিল। সাহা নীলাকে ডেকে নিয়েছিল একটা ঝোপের আড়ালে। একটু আদর-সোহাগ, একটু শরীর ঘষাঘষি করার জন্য। ডাক্তারদের পাঁচজন তখন শতরঞ্চিতে চিৎপটাং। সাহার চাহিদা মিটিয়ে এসে নীলার চোখ লতিকাকে খুঁজছিল। সে দেখল দীপক ডাক্তার আর লতিকা একটা শালগাছের নীচে বসে কথা বলছে। দু’জনের মধ্যে পাঁচ-ছ’হাতের তফাত। ধুস, কী যে হচ্ছে! মজা, হুল্লোড়, এলাহি খাওয়াদাওয়া, সবই হল সারাদিনে কিন্তু নীলার ধন্দটা রয়েই গেল। ফের বাস, ফের সেই নিজেদের চেনা ঘরের ছোপধরা দেওয়াল।
এই ঠান্ডায় স্নান করা যাবে না। মুখ-হাত ধুতে বাথরুমে যাচ্ছিল নীলা, তখনই দরজায় ঠুকঠুক। লতিকা। বড় বড় নিশ্বাস পড়ছে ওর। নীলার দিকে একবার তাকিয়েই মুখ নামিয়ে নিল। ‘‘কী ব্যাপার? কী হয়েছে?’’ চুপ করেই আছে লতিকা। এবার ওর হাত ধরে একটা ঝাঁকুনি দিল নীলা। ‘‘কী হয়েছে বলবি তো!’’ চোখ তুলল মেয়েটা। ওর চোখের তারায় একসঙ্গে খেলা করছে ভয়, লজ্জা এবং খুশি। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘‘আমাকে উনি চেয়েছেন।’’
‘‘চেয়েছেন! তার মানে কী?’’ নীলা রসিকতার লোভ সামলাতে পারল না। ‘‘এ কি ছোটবেলার সেই খেলা নাকি? এলাটিং বেলাটিং সই লো…রাজামশাই একটি বালিকা চাইলো! কী বলেছে খুলে বল দেখি!’’
‘‘কী আবার? ওই যা বললাম, তাই। বলল, ‘তোমায় ভালবেসে ফেলেছি। তোমায় আমি চাই।’
‘‘ব্যস? আর কিছু না?’’
‘‘না।’’
‘‘তা তুই কী বললি?’’
‘‘বলিনি কিছু। তখনই তো তুই ডাকলি।’’
‘‘ভাল, ভাল। কী বলবি ঠিক করেছিস?’’
‘‘জানি না, যা।’’ শিহরিত লতিকা মুখ নামাল। নীলা কিন্তু নাছোড়বান্দা। ‘‘না জানলে হবে না সোনা। ভেবে দেখ, ডাক্তারের বউ আছে। তা সত্ত্বেও তোকে চাইছে। কী হিসেবে? আমি যেমন আছি, সেইরকম তো? তা হলে কিন্তু পাওনাগণ্ডাটা আগে থেকে ঠিক করে নিস।’’ লতিকা অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘যাহ্।’’
৪
তিনতলা যে বাড়িটা এখন ওদের স্টাফ কোয়ার্টার, একসময় সেটাই ছিল নার্সিংহোম। তেরোজন মেয়ে লোকাল, তারা বাড়ি থেকে যাতায়াত করে। বাকিরা এখানেই থাকে, একতলায়। দোতলায় এককালের ওটি এখন স্টোররুম। তার দু’ধারের চারটে কেবিনের দুটি নীলা আর লতিকার দখলে। বাকি একটি সুবল সাহার বিলাসকক্ষ, অন্যটি সাজনো-গোছানো অবস্থায় তালাবন্ধ থাকে, দরকারে-অদরকারে রাত্রিবাস করা ডাক্তারদের জন্য। ডাক্তার দীপক আচার্য গোড়া থেকেই সপ্তাহে একদিন ওটা ব্যবহার করে আসছে। বুধবার বিকেলে এসে প্রথমে চেম্বার করে, তারপর একগাদা ওটি করতে করতে রাত হয়। সুতরাং রাত কাটিয়ে বৃহস্পতিবার ভোরে মেডিক্যাল কলেজের কোয়ার্টারে ফেরে।
৩১ ডিসেম্বরের পর এই রুটিনে সামান্য বদল হয়েছে। ডিনারের পর ঘণ্টা দেড়েক লতিকার ঘরে সময় কাটে তার। লতিকারই ওদিকের ঘরে যাওয়ার কথা, কিন্তু তাতে ওর ঘোর আপত্তি। যদি কেউ ওকে ও ঘর থেকে বেরতে দেখে ফেলে! তার থেকে এ-ই ভাল। লতিকা নিজে আগে বেরিয়ে সিঁড়ির মুখে গিয়ে ইশারা করে, তারপর আচার্য টুক করে নিজের ঘরে চলে যায়। লতিকা নীলাকে দিয়ে দিব্যি করিয়ে নিয়েছে, কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায়। নীলা কাউকে বলতে যাবেই বা কেন? ওরা তো বন্ধু। লতিকার চোখেমুখে আজকাল যে খুশি ছলকায়, তার কোনও দাম নেই? নীলার শুধু একটাই আফশোস, মেয়েটার বড় লোকসান যাচ্ছে। এই দু’মাসে একটা নকল পারফিউম আর দুটো মামুলি শাড়ি ছাড়া কিছুই পায়নি ও। এদিকে দোলের সময়ে ডাক্তারকে দেবে বলে দামি কোম্পানির শার্ট কিনে বসে আছে। তা হোক গে। ওর নিজের কপালে জোটেনি বলে সত্যিকারের ভালবাসা কি কেউ পেতে পারে না? আর সেটা পাওয়া মানেই তো সাতরাজার ধন মানিক পাওয়া। তার কাছে টাকাই বা কী আর বিয়েই বা কী?
প্রথম দিন নিজের হাতে লতিকাকে সাজিয়ে দিয়েছেল নীলা। চোখে সামান্য কাজল, ছোট্ট টিপ আর একটু লিপস্টিকের ছোঁয়া, তাতেই কী সুন্দর লাগছিল মাজা রঙের মেয়েটাকে! আগে তো ও এসবের ধারই ধারত না। এখন নিজে নিজেই একটু আধটু রূপটান দেয়, দিতে দিতে গুনগুন করে গানও করে।
আজও তেমনই করছিল লতিকা। দোল আর আট দিন দূরে। আজ আবার ডাক্তারের খুব তাড়া। চারদিনের ছুটি নিয়ে ভোর পাঁচটা দশের বাসে বাড়ি যাবে। হয়তো শ্বশুরবাড়িও যাবে, মেয়েকে দোলের উপহার দিতে। বিকেল বিকেল এসে চেম্বার সেরেই ওটি-তে ঢুকেছিল, ঝড়ের গতিতে চারটে মেজর, দুটো মাইনর কেস নামিয়ে দিয়েছে। এইবার ও আসবে। নীলা লতিকার প্রসাধন দেখছিল। ওর কাজল, লিপস্টিক, লজ্জা আর খুশিতে মাখামাখি মুখটা দেখে ‘‘বাহ্’’ বলে নিজের ঘরে চলে এল। আজ ওকে একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে। কী খেয়ালে কে জানে, সাহাবাবুও আজ রাতটা এখানে কাটাবে। অবশ্য তাতে খুব একটা চিন্তার কিছু নেই। সে আসে এগারোটা পার করে। নীলাদের রাত শুরু হয় বারোটার পর। তবু, দায়িত্ব একটা আছে বই কী। লতিকার অভিসার সম্পূর্ণ আড়াল করে ওকে আগলে রেখেছে ও। সুবল সাহাকেও কিচ্ছু বলেনি।
নিজের বন্ধ দরজার পাশে তক্কে তক্কে ছিল নীলা। খুট করে ছিটকিনি খোলার শব্দ হল পাশের ঘরে। লতিকার পা টিপে চলার শব্দ প্রায় পাওয়াই যায় না। তার একটু পরেই চপ্পলের ফটফট আওয়াজ বারান্দার অন্যদিকে মিলিয়ে গেল। তর সইছিল না নীলার। দরজা খুলে একছুটে লতিকার ঘরে এল। ‘‘কি রে, দিয়েছিস শার্টটা? কী বলল?’’
‘‘দুর, এখন দেব কেন? দোলের আগের দিন তো আসবেই।’’
‘‘দেখাসওনি?’’
‘‘আগেই দেখাব? তা হলে আর সারপ্রাইজ় কী হল?’’ একটু আশাহত হল নীলা। ওর আগ্রহ ছিল, কারণ শার্টটা ওর পছন্দেই কেনা। ‘‘ধ্যাত্তেরি। তোর সবেতেই বাড়াবাড়ি।’’ বলে মুখ ঘোরল ও। আর তখনই ওর চোখ পড়ল চেয়ারের পায়ার কাছে পড়ে থাকা পেটমোটা ওয়ালেটার দিকে। আজকেই বিয়াল্লিশ হাজার টাকার ভাউচারে সই করেছে ডাক্তার দীপক আচার্য। ‘‘তোর নাগর মানিব্যাগ ফেলে গেছে রে! তুই তো আর টাকা সরাবি না, আজ রাতটা না হয় বালিশের তলায় রেখে ঘুমো। দেখবি কী আরামের ঘুম হয় মাথার কাছে টাকা থাকলে।’’ লতিকা বলল, ‘‘ধ্যাৎ, অন্ধকার থাকতে বেরিয়ে যাবে। এখনই দিয়ে আসি, চল।’’
‘‘আমায় টানছিস কেন? যা না তুই।’’
‘‘না বাবা, আমি একা ও ঘরে ঢুকব না। কোথা থেকে কে…’’
টানা বারন্দার অন্যপ্রান্তে ওই ঘরদুটো। সাহার ঘরের দরজার তলা দিয়ে আলো আসছে। সর্বনাশ! ডাক্তারের গলার আওয়াজ আসছে তো ওই ঘর থেকেই! সাহার সামনে ফেরত দেবে কী করে ওয়ালেটটা? ডাক্তারের অভ্যেসই জোরে কথা বলা। ওর হা হা হাসি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কী বলছে ও? ‘‘কি ভেবেছিলেন মশাই আপনি? আপনি একাই শের, আমরা সব খেঁকশিয়াল? আপনি মালদার লোক, খরচ করে মেয়ে পুষতে পারেন। আমরা বাপু খেটে খাওয়া মানুষ, আমাদের কি আর রইসি পোষায়? ফেমিনিন সায়কলজি বোঝেন? একটু ম্যারিটাল আনহ্যাপিনেসের গপ্পো শুনিয়ে দিয়েছিলাম, ব্যস, তাতেই কাত। আর এইসব থার্টি প্লাস এজ গ্রুপের মেয়েছেলে, বিয়ে-শাদি হওয়ার কোনও সিন নেই…ইন ফ্যাক্ট, আই অ্যাম ডুয়িং আ সোশ্যাল সার্ভিস!…তবে যাই বলুন দাদা, এত চেখেছি, বেড পার্টনার হিসেবে এ এক্কেবারে চাবুক। আপনাকেও বলতাম চেখে দেখতে, কিন্তু বাড়ির পাশে থাকে, রিস্ক না নেওয়াই ভাল। যেখানে বাস, সেখানে চাষ করতে নেই।’’
সরে আসবে? কিন্তু নীলার পা’দুটো যে সিমেন্ট দিয়ে কেউ গেঁথে দিয়েছে! লতিকার দিকে তাকাতে পারছিল না নীলা। কিন্তু স্পষ্ট শুনল, দরজায় নক করছে ও। ডাক্তারের সচকিত গলা শোনা গেল, ‘‘কে?’’ ল্যাচ ঘুরিয়ে এক ঝটকায় দরজা খুলে ফেলল লতিকা। দু’পা এগিয়ে গেল ঘরের মধ্যে। খুব সহজ, স্বাভাবিক গলায় কথা বলছে ও, ‘‘এই ব্যাগটা আপনি ফেলে এসেছিলেন। নিন, ধরুন। আর হ্যাঁ, এর থেকে পাঁচটা হাজারের নোট নিচ্ছি আমি। আমার ফি। বাকিটা ঠিক আছে কি না গুনে নেবেন। আর এরপর থেকে একটা মাসকাবারি বন্দোবস্ত করে নেওয়াই ভাল, কি বলেন? সেসব দরদস্তুর না হয় পরে হবে। এখন আসি, কেমন?’’
যন্ত্রচালিতের মতো নীলা লতিকার পিছন পিছন ওর ঘরে এল। ভেঙে গেছে, মেয়েটা নির্ঘাত একেবারে ভেঙে গেছে। কী বলবে, কী সান্ত্বনা দেবে ওকে নীলা? আহ্, আপদ! ঠিক এই সময়ে বিছানার উপরে রাখা লতিকার ফোনটা বাজছে। এগারোটা বেজে গেছে, এত রাতে কে? এখন কি ও ফোনে কথা বলার মতো অবস্থায় আছে? নীলা ফোনটা হাতে নিল। নাম উঠছে — বড়দা। নীলা বলল, ‘‘হ্যালো।’’ ওপাশ থেকে রাগী গলায় ধমকের স্বর, ‘‘কী ব্যাপার কী তোর? ছাদ ঢালাইয়ের টাকাটা আজ নয় কাল করে ঝুলিয়ে রেখেছিস, এদিকে দেরি…’’ নীলা কোনওমতে বলল, ‘‘আ-আমি দি-দিচ্ছি লতিকাকে।’’ ফোনটা ছিনিয়ে নিল লতিকা। কানে লাগিয়ে বলল, ‘‘কী হল?’’ একটু চুপচাপ। হয়তো ওই একই ধমক শুনছে ও। এবার কথা ফুটল ওর গলায়, ‘‘আস্তে বড়দা, আস্তে। দুটো নয়, তিনটে ঘরের ঢালাই হবে একসঙ্গে…যা বলছি বুঝতে পারছ?… হ্যাঁ, তিনটে ঘর…আমারও তো একটা ঘর চাই, তাই না?…আর শোনো, মোক্তার দাদুকে একবার আসতে বোলো। বাবার বাড়ি, তিন ভাইবোনে পাকাপাকি ভাগ করে নেওয়াই ভাল। মানুষের মন তো, বলা যায় না, কোনদিন হয়তো আমিই সব দখল করে তোমাদের দু’ভাইকে কলা দেখালাম! তুমি বরং এর মধ্যে আইনের দিকটা ফাইনাল করে নাও। দোলের দিন আমি যাচ্ছি। ভয় নেই, তোমাদের ঢালাইয়ের খরচও আমিই দেব।’’
এক ঝটকায় সব হিসেব বুঝে নিতে শিখে গেছে লতিকা। এই কথাগুলোই এতদিন ওকে বোঝাতে চাইছিল নীলা। লতিকার চোখ দুটো জ্বলছে। নীলার তো খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু দলা পাকিয়ে কান্না উঠে আসছে কেন ওর গলায়? কেন মনে হচ্ছে ওর নিজের শেষ আশ্রয়টাও চুরমার হয়ে গেছে? লতিকার মুখে তো এক আশ্চর্য হাসি! হাসিমুখে নীলার দিকে তাকিয়ে লতিকা দেখল নীলার চোখে সাচ্চা দুটো মুক্তো টলটল করছে। দু’পা এগোল লতিকা, নিজের ওষ্ঠাধরে মুক্তাবিন্দুদুটি শুষে নিতে নিতে বলল, ‘‘আয়।’’
সংগ্রহ : সানন্দা