স্পেনে করোনা আক্রান্ত ৩২ বাংলাদেশী
দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের দেশ স্পেনে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৩২ বাংলাদেশী। আক্রান্ত বাংলাদেশীদের বেশির ভাগই ঢাকা ও সিলেটের বাসিন্দা বলে স্পেন কমিউনিটির নেতারা জানিয়েছেন। দেশটিতে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে উত্কণ্ঠায় রয়েছেন সেখানে অবৈধভাবে থাকা বাংলাদেশী নাগরিকরা। এমন প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশী নাগরিক স্পেনে নিগ্রহের শিকার হতে পারেন বলে জানিয়েছেন দেশটিতে থাকা প্রবাসীরা।
জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির করোনাভাইরাস রিসোর্স সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, স্পেনে এখন পর্যন্ত ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছে ৫৬ হাজার ১৮৮ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৪ হাজার ৮৯ জনের। করোনায় স্পেনে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় ভয়-উত্কণ্ঠা ভর করেছে বাংলাদেশীদের মধ্যে। অন্যদিকে দেশটিতে অবৈধ বাংলাদেশীদের ভরণ-পোষণ কী হবে, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। করোনায় স্পেনে এসব বাংলাদেশী নিগৃহীত হতে যাচ্ছেন বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সেখানকার প্রবাসীরা।
স্পেনে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্পেনে অন্তত ১০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশী রয়েছেন। যাদের বড় একটি অংশ ফুটপাতে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এসব ব্যবসার মধ্যে কাপড়, গ্রোসারি, ডোনার কাবাব ও ফল ব্যবসা অন্যতম।
করোনায় পুরো স্পেন লকডাউন হওয়ায় এখন আর ব্যবসা করতে পারছেন না কেউ। অন্যদিকে বৈধ কাগজপত্র না থাকায় সরকারি সহায়তা পাওয়ার সুযোগ নেই তাদের। এতে অবরুদ্ধ জীবন আর মৃত্যু আতঙ্ক নিয়ে দিন পার করছেন তারা।
স্পেনের বৃহৎ শহর বার্সেলোনার ফুটপাতে কাপড়ের ব্যবসা করতেন বাংলাদেশী মকবুল হোসেন। পুরো স্পেন লকডাউন হওয়ায় এখন তার ব্যবসা বন্ধ। বৈধ কাগজপত্র নেই বলে বার্সেলোনায় এ ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। এ ব্যবসা করে দেশে পরিবারের কাছে টাকা পাঠান। করোনায় গোটা স্পেন প্রায় এক মাস ধরে লকডাউন হওয়ায় দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন তিনি। ব্যবসা না থাকায় কীভাবে চলবেন, দেশে পরিবার কীভাবে চলবে এমন হতাশা ভর করেছে তার মধ্যে। এমন অবরুদ্ধ সময়ে দেশে গিয়ে যে পরিবারের পাশে থাকবেন, এমন পরিস্থিতিও এখন আর নেই।
রাজধানী মাদ্রিদ শহরের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে কাজ করেন বাংলাদেশের আব্দুর নূর নিরব, মকবুল, মাসুম বিল্লাহ ও সাগর হোসেন। রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকায় বাসায় আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন তারা। পুরো স্পেনে করোনা রোগী বেড়ে যাওয়ায় জীবন নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভয়ে আছেন। অবৈধ হওয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে কোনো অর্থসহায়তা না পাওয়ায় ঠিক কী করবেন, তা বুঝতে পারছেন না তারা।
অন্যদিকে স্পেনে এমন দুঃসময়ে অবৈধ এসব বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে কোনো ধরনের অর্থসহায়তা পাবেন কিনা, তাও পরিষ্কার নয়। এমন অবস্থা দীর্ঘ হলে স্পেনে এসব বাংলাদেশীর কী অবস্থা তৈরি হবে, তা নিয়ে কমিউনিটিতেও প্রশ্ন উঠেছে।
অবৈধ এসব বাংলাদেশীকে অর্থসহায়তার বিষয়ে জানতে চাইলে স্পেনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব মো. মোত্তাসিমুল ইসলাম জানান, অবৈধদের সহযোগিতার বিষয়ে ঠিক এ মুহূর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। তবে করোনা পরিস্থিতি ও আর্থিক সহায়তার বিষয়ে স্পেন দূতাবাস তিন সপ্তাহ আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল, সেই চিঠির উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
স্পেনে বাংলাদেশী কমিউনিটি সংগঠন ‘ভ্যালিয়েন্টে বাংলা’র সভাপতি ফজলে নূর এলাহি জানান, ‘আমরা করোনায় আক্রান্ত বাংলাদেশীদের খোঁজখবর জানার চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে দেশটির বিভিন্ন সংস্থার দেয়া সহায়তা অবৈধ বাংলাদেশীরা যাতে পান, সে বিষয়েও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
উল্লেখ্য, ইউরোপের দেশ স্পেনে অন্তত ৩০ হাজার বাংলাদেশী রয়েছেন। এর মধ্যে বৈধ কাগজপত্র নিয়ে বসবাস করেন ২০ হাজার। বাকিরা অবৈধভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ফুটপাতে ব্যবসা করেন।
মাদ্রিদে বসবাসরত বাংলাদেশ কমিউনিটি নেতা ও গণমাধ্যমকর্মী ইসমাঈল হোসেন রায়হান জানান, পুরো স্পেনে কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে। কোথাও বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অবরুদ্ধ অবস্থায় জীবন যাপন করছি। তবে সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ হলো করোনাভাইরাসে বাংলাদেশীদের আক্রান্ত হওয়ার খবর। এটা কমিউনিটির মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। ভয়ে কেউ কারো সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ করছেন না।
করোনায় বিপর্যস্ত স্পেনের হাসপাতালগুলোতে রোগী রাখার কোনো জায়গা নেই। এরই মধ্যে অক্সিজেন সংকটে ৬৫ বছরের বেশি আক্রান্তকে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় দেশটির বিভিন্ন শহরের হোটেল, রেস্তোরাঁ, শপিং মল, গণপরিবহন, সরকারি-বেসরকারি অফিস, স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। লকডাউন আইন অমান্য করায় এরই মধ্যে আড়াই হাজারের মতো নাগরিককে মোটা অংকের জরিমানা করা হয়েছে।
এদিকে স্পেন লকডাউন ঘোষণা করায় সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশীরা বাংলাদেশ সরকারের সহায়তা চেয়েছেন। গত ২৪ মার্চ প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য অর্থসহায়তা চেয়ে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দিয়েছে স্পেনে বাংলাদেশ দূতাবাস। চিঠিতে বলা হয়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে স্পেনের পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে। এখন পর্যন্ত দেশটিতে ৩২ বাংলাদেশী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। যার মধ্যে দুজন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। ১৪ মার্চ থেকে সারা দেশ লকডাউন ঘোষণা করেছে স্পেন সরকার। এর ফলে বিপাকে পড়েছেন দেশটিতে বসবাস করা প্রায় ৩০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশী। যাদের অধিকাংশই পর্যটননির্ভর ছোট ব্যবসা, দিনমজুর ইত্যাদি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সাম্প্রতিক লকডাউনের ফলে এদের অধিকাংশই আয়-রোজগারবঞ্চিত হয়ে সপরিবার দুর্বিষহ দিন যাপন করছেন।
দূতাবাসের প্রথম সচিব মুহাম্মদ মুতাসিমুল ইসলামের লেখা চিঠিতে আরো বলা হয়, স্থানীয় বাংলাদেশী অ্যাসোসিয়েশন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্থা প্রায় দুই হাজার অসহায় ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে চাল, ডাল, তেলসহ অতিপ্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহের কার্যক্রম শুরু করেছে। তারা এ অবস্থায় রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের সহায়তা কামনা করেছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত দূতাবাসে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিলে ৫৯ হাজার ৫৬৯ ইউরো জমা রয়েছে। তহবিলের ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেটে পঙ্গু, অসুস্থ ও বিপদগ্রস্ত কর্মীদের আর্থিক সাহায্যে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। কভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে এ তহবিলে জরুরি ভিত্তিতে ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিলে প্রাথমিকভাবে প্রবাসী কর্মীদের সহায়তা দেয়া সহজতর হবে।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের উপপরিচালক জাহিদ আনোয়ার বলেন, আমরা দূতাবাসের চিঠি পাওয়ার পর পরই স্পেনের দূতাবাসের জন্য ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ অনুমোদন দিয়েছি। তাছাড়া বিদেশে বাংলাদেশের সব মিশনকে জানানো হয়েছে, প্রবাসীদের জন্য এ ধরনের মানবিক সহায়তা প্রস্তুত হলে তা দিতে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড প্রস্তুত রয়েছে।