ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যা সাতটা ৫৮ ছুঁলেই ঢেউয়ের মতো এগিয়ে আসে শব্দটা। ছন্দোবদ্ধ হাততালির শব্দ।
গোধূলির অস্তরাগের পটভূমিতে সারি সারি বহুতলের সমস্ত মানুষ তত ক্ষণে এসে পৌঁছেছেন ব্যালকনিতে, কেউ বা ছাদে। সময় নির্ধারিত ঠিক সন্ধ্যা ৮টা। শুরু হয় হাততালি। মিনিট দু-পাঁচ সে তালি থামার পরে সমবেত কণ্ঠে গান— কোনও দিন স্পেনের জাতীয় সঙ্গীত, কোনও দিন অন্য কোনও দেশাত্মবোধক গান। ভাষা জানি না, কিন্তু সুরের দৃপ্ত ভাব দিব্য বুঝতে পারি। ১৪ তারিখ লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে এ ছবি প্রাত্যহিক। গোটা দিনের ক্লেদ-ক্লান্তি ঝেড়ে এ যেন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক নতুন অঙ্গীকার, বাধ্য-বিচ্ছিন্নতার মধ্যে ঐক্যের আন্তরিক নির্ঘোষ।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। কাঁসর-ঘণ্টা পিটিয়ে পিটিয়ে ভেঙে ফেলার প্রশ্ন নেই, ভাইরাস ধ্বংসের নামে ঘণ্টাতত্ত্বের জিগির তুলে মিছিলও নেই। লকডাউনে পূর্ব স্পেনে সাগরতীরের এই ছোট্ট পাহাড়ি শহরের রাস্তাঘাট একেবারেই জনশূন্য। কিন্তু বাস চলছে, ট্রাম ছুটছে— যদি কারও প্রয়োজন পড়ে। তবে তার সংখ্যাও আগের চেয়ে কম। শহরের বড় শপিং মলগুলো খোলা। সেখানে পণ্যের টানাটানি নেই। কিন্তু এক সঙ্গে ১০ জনের বেশি ভিতরে যেতে পারবেন না। বাকিদের যত্ন করে হাত ধুয়ে অপেক্ষায় থাকতে হবে। স্বাস্থ্য পরিষেবাও খুবই ভাল, তবুও সংক্রমণ লাফিয়ে বাড়ছে এখানে, মৃতের সংখ্যাও।
কেন? আমার মনে হয়েছে, প্রথমে বিষয়টিকে একেবারেই গুরুত্ব না-দেওয়ার মাসুল গুনছে স্পেনবাসী। ইটালির মানুষের মতো এঁদেরও ধারণা ছিল, চিন তো বহু দূর! আমি কিন্তু ভাবগতিক দেখে ৭ মার্চ থেকেই স্বেচ্ছা কোয়রান্টিন নিয়েছি। তার আগে মাস-দেড়েকের চাল-ডাল কিনে ঘরে তুলে ফেলেছি। ৫ তারিখেই আমার স্পেনে থাকার মেয়াদ ফুরিয়েছিল। তিন রুমমেট বেরিয়ে গেলেও আমার যাওয়ার কথা ছিল মলদ্বীপে, নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে। কিন্তু তার আগেই বিপত্তি। ৬ তারিখেও আমি ঘুরে এসেছি ফ্রান্সের সীমান্ত পর্যন্ত। আমার শরীরে কোভিড-১৯-এর কোনও লক্ষণ নেই। কিন্তু জানি না, আমি করোনাভাইরাসের এমন কোনও বাহক কি না, যার নিজের দেহে অসুখের কোনও লক্ষণ প্রকাশ পায় না।
এই সব ভেবেই কিন্তু আমি হুগলির বৈদ্যবাটীতে নিজের বাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা পাল্টে সোজা কর্মস্থলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা রয়েছেন। প্রতিবেশীরা কথা বলতে এলে তাঁদেরও ফেরানো সম্ভব নয়। করোনাভাইরাস যে-মাত্রায় ছোঁয়াচে, তাতে এটা তো বিরাট ঝুঁকির ব্যাপার। বেলা করে ঘুম থেকে উঠে রান্নাবান্নার তোড়জোড়, টিভি দেখা, পড়াশোনা— কেটে যাচ্ছে একটার পর একটা দিন। এ দিকে মৃত্যুর সংখ্যায় চিনকে ছাপিয়ে ইটালিকে প্রায় ধরে ফেলেছে স্পেন। দেখছি আর চিন্তা বাড়ছে দেশের জন্য। মানুষের এই সচেতনতা, এই অত্যাধুনিক স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নিয়েও স্পেনের এই ছবি। দেখি ভারতের অনেকেই এখনও হালকা ভাবে দেখছেন লকডাউনকে। জানি না কী হবে ভারতের ভবিষ্যৎ।
ধন্যবাদ জানাতেই হয় স্পেনের ভারতীয় দূতাবাসকে। প্রতিদিন মেল পাঠিয়ে খোঁজ রাখেন তাঁরা। উৎসাহ দেন, ভরসা জোগান। ওঁদের জন্যই অজ্ঞাতবাস হয়ে ওঠেনি অনির্দিষ্ট কালের এই স্বেচ্ছাবন্দিত্ব। আর আছে টেলিফোন, বন্দিশালা থেকে বাকি বিশ্বের গবাক্ষ।