সেশেলস পূর্ব আফ্রিকাতে ভারত মহাসাগরের মাঝে ছোট একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। প্রসাশনিক ভাবে দেশটির নাম রিপাবলিক অফ সেশেলস। পূর্ব আফ্রিকার মূল ভূগন্ড থেকে প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই দেশটি। প্রায় ১১৫ টি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত সিশেলস এবং এর রাজধানী হলো ভিক্টোরিয়া। অন্যান্য নিকটবর্তী দ্বীপ দেশ ও অঞ্চলগুলি হলো কমোরোস আইল্যান্ডজ, মায়োট, মাদাগাস্কার, রেউনিওন এবং দক্ষিণে মরিশাস রয়েছে। পাশাপাশি মালদ্বীপ এবং ব্রিটিশ ভারত মহাসাগর অঞ্চল পূর্ব দিকে রয়েছে। দেশটির মোট জনসংখ্যা প্রায় ৯৪২২৪ জন এবং এটি স্বাধীন আফ্রিকান দেশ গুলো মধ্যে সবচেয়ে কম জনসংখ্যার দেশ। সেশেলস আফ্রিকান ইউনিয়ন, দক্ষিণ আফ্রিকান উন্নয়ন সম্প্রদায়, জাতিসংঘের কমনওয়েলথ এবং জাতিসংঘের সদস্য হিসাবে তালিকাভূক্ত রয়েছে। ১৯৭৬ সালে দেশটি যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছে এবং তারপর দেশটি কাতের কৃষি ও পর্যটন বিকসিত করার মাধ্যমে ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
সেশেলস দ্বীপপুঞ্জ প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য৷ সেশেলস সস্তা টুরিজমের পথ না ধরে, দিনে দু’হাজার ইউরো হোটেলভাড়া দিতে রাজি এমন পাঁচতারা পর্যটকদের আকর্ষণ করেছে৷ স্বর্গরাজ্যকে বাঁচিয়ে রাখার হয়ত সেটাই শেষ পন্থা৷ কাব্যি করে বলতে গেলে, এমন একটা জায়গার প্রেমে পড়া সহজ কাজ৷ চারশ বছর আগে যে সব নাবিক আর মাল্লা সেশেলস দ্বীপপুঞ্জে প্রথম পা দিয়েছিলেন, তাদের থেকে শুরু করে আজকের হলিউড স্টার – সেশেলসের প্রেমে পড়েননি, এমন কেউ নেই।
পৃথিবীর সবচেয়ে দামি হোটেলগুলির মধ্যে একটিকে পাওয়া যাবে ঠিক এখানেই: রাত্রিবাসের মাশুল মাথাপিছু দু’হাজার ইউরো৷ নব্বইয়ের দশকের শেষে এক সুবিশাল পর্যটন সংস্থা এলাকাটি কিনে নিয়ে নর্থ আইল্যান্ড রিসর্ট নামের পাঁচতারা হোটেলটি বানায়৷ হোটেলের অতিথিরা দ্বীপের বাসিন্দাদের সঙ্গে মিলেমিশেই থাকেন৷ নর্থ আইল্যান্ড রিসর্ট-এর পরিবেশ ব্যবস্থাপক কার্ল হাফেমান বলেন, ‘‘নর্থ আইল্যান্ডে সব কিছু করা হয় পরিবেশের কথা মনে রেখে৷ দ্বীপটা কেনার মূল কারণ ছিল, মানুষ এখানে আসার আগে দ্বীপটা যেরকম ছিল, তাকে আবার সেরকম করে তোলা৷ নর্থ আইল্যান্ডকে সেশেলস-এ জীববৈচিত্র্যের হটস্পট করে তোলার বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে৷”
জীববৈচিত্র্য
জীববৈচিত্রই সেশেলসকে বিখ্যাত করে তুলেছে৷ এখানে এমন অনেক গাছপালা আর পশুপাখি পাওয়া যায়, যা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না৷ ব্লু পিজিয়ন, হোয়াইট আই, হোয়াইট-টেলড ট্রপিকবার্ড, কত ধরনের পাখি আছে এখানে৷ পক্ষীবিশারদদের কাছে সেশেলস একটা নিজস্ব জগত৷
জীববিজ্ঞানী লিন্ডসে চং সেং সেশেলসের সেই জগতটাকে যেমনভাবে চেনেন, তেমনভাবে আর কেউ চেনে কিনা সন্দেহ৷ জীববৈচিত্র্যের চলন্ত বিশ্বকোষ বলা হয় তাঁকে৷ সেশেলসেই তাঁর জন্ম, দশকের পর দশক ধরে এই জগতটাকে দেখছেন তিনি৷ লিন্ডসে বলেন, ‘‘আমার কাছে ওটাই আসল৷ আমি এই ‘এন্ডেমিক্স’, মানে যে সব গাছপালা, পশুপাখি শুধু এখানেই পাওয়া যায়, তাদের দেখতে ভালোবাসি৷ আমাদের কী সম্পদ আছে, সেটা বোঝার আগে, সে সম্পর্কে জানা চাই৷ এই সব জীবের মধ্যে অনেকগুলোই এতটা ‘ক্রিপ্টিক’, মানে গোপন বা ছদ্মবেশী, যে শুধু বিশেষজ্ঞরাই তাদের সম্পর্কে জানেন৷ আমি এই বিরল প্রাণীদের পরিচিত করে তোলার চেষ্টা করছি৷”
যে কারণে লিন্ডসে চং সেং সেশেলসের মুখ্য দ্বীপ মাহে-র বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন৷ সেশেলসের নব্বই হাজার অধিবাসীর অধিকাংশের বাস এখানে৷ সেশেলস দ্বীপপুঞ্জ প্রায় ৪০ বছর আগে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পায়৷ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের ছাপ রয়েছে বাড়িঘরে, বামহাতি যানচলাচল আর রাজধানীর নামে৷ সেশেলসের রাজধানীর নাম হলো ভিক্টোরিয়া ।
পাঁচতারা পরিবেশ
বছরে প্রায় দু’লক্ষের বেশি মানুষ সেশেলসে ছুটি কাটাতে আসেন৷ পর্যটন হলো দেশের আয়ের মূল উৎস৷ সেশেলসের কোথাও বড় বড় হোটেল কমপ্লেক্স খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ পাওয়া যাবে নানা পাঁচতারা হোটেল৷ তাদের মধ্যে অনেক হোটেলই আজ পরিবেশবান্ধব বলে নাম কিনেছে৷ প্রাসলিন দ্বীপের বৃহত্তম হোটেলগুলির মধ্যে একটির নিজস্ব সৈকত ফেলে রাখা হয়েছে সামুদ্রিক কচ্ছপদের জন্য, যাতে তারা সেখানে বিনা বাধায় ডিম পাড়তে পারে৷
সৈকতের ঠিক পিছনেই পাওয়া যাবে একটি গল্ফ লিংকস – যদিও পরিবেশ সংরক্ষণকারীরা তার বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন৷ পরিবেশ সংরক্ষণ আর পর্যটক বিনোদনের মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলা সবসময় খুব সহজ নয়৷
এর মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরেই ‘ভালে দ্য মে’, যা ইউনেস্কোর তরফ থেকে বিশ্ব প্রাকৃতিক উত্তরাধিকার হিসেবে স্বীকৃত৷ ‘কোকো দ্য ম্যার’ বা সাগরের নারকেলগুলি ২৫ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ভারি হতে পারে৷ বিশ্বের আর কোনো উদ্ভিদের এতো বড় বীজ নেই৷ লিন্ডসে জানালেন, ‘‘কোকো দ্য ম্যার-এর কথা ভাবলে আমি খুব গর্ব বোধ করি৷ এই ফলটাকে সেশেলসের প্রতীক বলা চলে৷ সেটা একটা দায়িত্বও বটে৷ এই ফল তো আর শুধু আমাদের নয়, এটা সারা পৃথিবীর সম্পত্তি৷ শুধু এটা এখানে পাওয়া যায় বলে আমরা বাদবাকি পৃথিবীর হয়ে এর দেখাশোনা করি৷ কাজেই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, ফলটা যাতে নিশ্চিহ্ন না হয়ে যায়৷’
প্রকৃতি সচেতনতা
সারা দেশেই প্রকৃতি সম্পর্কে এই সচেতনতা আছে৷ সেশেলসই বিশ্বের প্রথম দেশ, যারা প্রকৃতি সংরক্ষণকে তাদের সংবিধানের অংশ করে৷ কয়েকটি এলাকা পুরোপুরি সংরক্ষিত, বিশেষ করে সমুদ্রবক্ষে৷ কোরাল রিফ বা প্রবালপ্রাচীরগুলো নষ্ট হতে শুরু করার পর তাদের একটা বড় অংশ আবার কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে – বিশেষ করে একটি প্রকল্পের কল্যাণে৷ ভেঙে যাওয়া প্রবালগুলিকে জলের তলাতেই এক ধরনের বিশেষ আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া হচ্ছে৷
ইউএনডিপি-র ডেভিড মায়ার্স বলেন, ‘‘এই প্রবালপ্রাচীর বা জলের তলায় জীববৈচিত্র্য যদি হারিয়ে যায়, তবে সেশেলস অন্য যে কোনো সমুদ্রসৈকতের মতো হয়ে উঠবে৷ বিশ্বে সে ধরনের সমুদ্রসৈকতের তো কোনো অভাব নেই৷”
সেশেলসের পরিবেশ, জ্বালানি ও জলবায়ু সংরক্ষণ মন্ত্রী দিদিয়ের ডগলে বলেন, ‘‘আমরা যত বেশি জানছি আর আমাদের কর্মক্ষমতা বাড়ছে, ততই আমাদের আস্থা বাড়ছে যে, আমরা সেশেলসকে বিশ্বের অন্যতম স্বর্গরাজ্যে পরিণত করতে পারব৷”