করোনাভাইরাস এখন পুরো বিশ্বজুড়ে এক আতঙ্কের নাম। চীনে এ ভাইরাসের জন্ম হলেও এখন বিশ্বের প্রায় ১৬৩টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর ছোবল আমেরিকাতেও পড়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যে জাতীয়ভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। ইউরোপের দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিছিন্ন করেছেন। অনেক বিমান তাদের ফ্লাইট সীমিত করেছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি ঘোষণার আগে নিউইয়র্কসহ প্রায় ৫০টি স্টেটে ইমার্জেন্সি ঘোষণা করেন ঐসব স্টেটের গভর্নর এবং মেয়র। ওয়াশিংটন স্টেটে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটে প্রায় ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে নিউইয়র্কে ৮২ বছর বয়সী এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ জানা গেছে, নিউইয়র্কে প্রায় ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজারের মত। মৃত্যুর মধ্যে ওয়াশিংটন স্টেটেই সর্বাধিক ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। করোনা ভাইরাসের এ ভয়াল থাবা এখন আমেরিকার প্রতিটি স্টেটে। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে নিউইয়র্ক।
বিশেষজ্ঞের মতে, নিউইয়র্কে করোনাভাইরাসে মানুষ বেশি আক্রান্ত হতে পারে। এর কারণ এ সিটিতে মানুষের সংখ্যা বেশি এবং এর মধ্যে অবৈধ অভিবাসী রয়েছে বেশি। তাদের কোন স্বাস্থ্যবিমা নেই, যে কারণে তারা ডাক্তার বা হাসপাতালে যেতে চান না।
অন্যদিকে এ সিটির মানুষের যাতায়ত বেশি সাবওয়ে এবং বাসে।
এক সপ্তাহ আগে নিউইয়র্ক সিটির গভর্নর এন্ড্রু কুমো যখন স্টেট ইমার্জেন্সি ঘোষণা করেন, তখনো নিউইয়র্কবাসীর মধ্যে তেমন আতঙ্ক ছিলো না, কিন্তু মেয়র বিল ডি ব্লাজিও যখন স্টেট ইমার্জেন্সি ঘোষণা করে বলেন, নিউইয়র্কে এক সপ্তাহের মধ্যে এক হাজারের বেশি করোনায় আক্রান্ত হবেন- তখনই মানুষের মধ্যে চূড়ান্ত ভীতি দেখা দেয়। একসময় আমেরিকান লোকজন বড় বড় স্টোর- ওয়ালমার্ট, কসকো, সিভিএস, টার্গেট, ওয়ালগ্রিন থেকে নিত্যপ্রয়োজনী জিনিসপত্র কয়েক মাসের জন্য মজুদ শুরু করে। বিশেষ করে এসব স্টোরে চাল, পানি এবং অন্যান্য শুকনা খাবারের জন্য ক্রেতাদের মধ্যে মারামারি শুরু হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ডাকার ঘটনাও ঘটে। এর ফলে পরিবর্তন করা হয় স্টোর পলিসির। কেউ একটির বেশি আইটেম নিতে পারবেন না। তারপরও অনেক এখন স্টোর ফাঁকা। মালামাল নেই। অন্যদিকে হ্যান্ড স্যানিটাইজারতো বাজার থেকেই উধাও। যাও পাওয়া যায়, তার দামও অনেক বেশি। যে কারণে নিউইয়র্ক সিটি নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করা হচ্ছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। হ্যান্ড স্যানিটাইজারের সংকট এখনো বাজারে।
আমেরিকানদের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশি এবং দক্ষিণ এশিয়ান কম্যুনিটির লোকজনও পরিস্থিতিতে বাসায় বাজার মজুদ করা শুরু করেছেন। এর ফলে বাজারে চাল, মাংস, ডালসহ শাকসব্জির সংকট দেখা দিয়েছে। গত ১৪ এবং ১৫ মার্চ জ্যাকসন হাইটসসহ বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা জ্যামাইকা, ব্রঙ্কস, ব্রুকলিন, ওজনপার্কসহ বিভিন্ন এলাকার গ্রোসারিগুলোতে বেশ ভিড় পরিলক্ষিত হয়।
জ্যাকসন হাইটসের প্যাটেল ব্রাদার্স ক্রেতাদের চাপের কারণে ঘন্টায় ঘন্টায় বন্ধ করে দেয়া হয়। এক ঘন্টা বন্ধ রাখার পর কিছু কাস্টমার নতুন করে ঢোকানো হয়। পুরানো কাস্টমার বের হবার পর আবার দরজা খুলে দেয়া হয়। অনেককে প্যাটেলে ঢোকার জন্য বাইরে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
প্যাটালের একজন কর্মকর্তা জানান, অতিরিক্ত কাস্টমার একসঙ্গে ভেতরে ঢুকলে ফায়ার ডিপার্টমেন্ট দোকান বন্ধ করে দিতে পারে, সেই কারণে এ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ ঘটনা প্যাটেল ব্রাদার্স প্রতিষ্ঠার পর প্রথমবারের মত ঘটলো। অন্যদিকে বাংলাদেশিসহ অন্যান্য গ্রোসারিগুলোতেও ছিলো প্রচণ্ড ভিড়। তারা বলেন, এমন এক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছেন যে, সবাই চেষ্টা করছেন অন্তত তিনমাসের পণ্য বাসায় স্টক করতে।
তারা আরো বলেন, আগে দেখা যেতো নিউইয়র্কের মানুষ এক সপ্তাহ বা এক মাসের জন্য বাজার করতো। করোনাভাইরাসের পর দেখা যাচ্ছে এক সপ্তাহের পরিবর্তে তারা তিনমাসের বাজার করছেন। আমরাতো অনেক ক্ষেত্রেই নিত্যদিনের চাহিদামত পণ্য সরবরাহ করে থাকি। যখন একজন ক্রেতা এক মাসের পরিবর্তে তিন মাসের বাজার করছেন, তখনতো বাজারে সরবরাহ আর থাকে না। আর বাজারে যখন পর্যান্ত সরবরাহ থাকে না, তখনই জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। আবার হোলসেল ব্যবসায়ীরাও সেই সুযোগ গ্রহণ করেন। যার ফলে চাল, ডাল, আটা, মাংসসহ শাকসব্জির অগ্নিমূল্য। ইতিমধ্যেই ২০ ডলারের ২০ পাউন্ড চাল ২৫ থেকে ২৮ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। ডালের মূল্য ৪/৫ ডলার বেড়ে গিয়েছে। মাংসের দামও বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশি মালিকানাধীন হোল সেল ব্যবসায়ী হক এন্ড সন্স এবং নিউ হক এন্ড সন্সের চেয়ারম্যান একে এম ফজলুল হক বলেন, মানবিক দিক বিবেচনা করে আমরা কোন জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি করিনি। যদিও আমাদের আগের তুলনায় বেশি অর্থ দিয়ে পণ্য কিনতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা সাধারণত ড্রাই ফুড বিক্রি করে থাকি। আমাদের আইটেমের মধ্যে মুসুরের ডালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা আগে ২০ টন তার্কিস মুসুরের ডাল কিনতাম ৭৫০ ডলারে। এখন সেই ডাল কিনতে হচ্ছে ১২৫০ ডলারে। সত্যি কথা বলতে কি- আমরা এখন বলতে গেলে ডাল লস দিয়েই বিক্রি করছি। তবে যেটুকু শোনা যাচ্ছে, মানুষের আগ্রহকে পুঁজি করে সাধারণ গ্রোসারি মালিকরাই দাম বৃদ্ধি করেছেন।
তিনি বলেন, আতঙ্কে মানুষ পাগলের মত বাজার করছে। স্টক করছে। বাসার জন্য ২/৩ মাসের পণ্য ক্রয় করছে। তারা যদি পাগলের মত বাজার না করতো তাহলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না।
তিনি বলেন, ডাল ছাড়াও হক এন্ড সন্স এবং নিউ হক এন্ড সন্সের কয়েক হাজার আটইটেম রয়েছে। আমরা কোন আইটেমের মূল্য বৃদ্ধি করিনি।
তিনি বলেন, ব্যবসার অপর নাম মানব সেবা। অধিক মুনাফার লোভে মানুষকে জিম্মি করে আমরা ব্যবসা করতে চাই না। সাধ্য মতো মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে চাই এবং সবার দোয়া চাই।
জ্যাকসন হাইটসের হাটবাজারের মনসুর চৌধুরী জানান, বাজারের অবস্থা ভাল না। কারণ বাজারে পর্যাপ্ত জিনিসপত্র নেই। যারা এক সপ্তাহের বা একদিনের বাজার করতেন, তারাও এখন এক মাস বা দুইমাসের বাজার করছেন। যে কারণে বাজারে চাল, ডাল, মাংস, তেলসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, চাল এবং ডালে ২ থেকে ৩ ডলার পর্যন্ত বেড়েছে। হোলসেল কোম্পানিগুলো গরুর মাংসের দাম পাউন্ডে ৬০ সেন্ট, চিকেন প্রতি পাউন্ড ৩০ সেন্ট বাড়িয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন, বাজারের পর্যাপ্ত মালামাল নেই বলেই হোলসেলাররা দাম বাড়িয়েছেন।
জ্যামাইকার ফাতেমা গ্রোসারির ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার জানান, করোনা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির কারণেই মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাজার করছে। যে কারণে বাজারের চাল এবং ডালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
সাউথ জ্যামাইকার তিতাস সুপার মার্কেটের আবুল ফজল দিদারুল ইসলাম জানান, কিছু কিছু জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি করা হলেও আমি কোন জিনিসের মূল্য বাড়ায়নি। আমি আগের দামেরই জিনিসপত্র বিক্রি করছি। তিনি বলেন, আমি অসহায়ত্বেও সুযোগ নিয়ে চাই না। নিজের একটু ক্ষতি হলেও মানুষের সেবা করতে চাই।
ব্রুকলীন থেকে জাহিদ মিন্টু জানান, ব্রুকলীনে অধিকাংশ দোকানেই আগের মাল আগের দামে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে যে সব জিনিসের দাম বেড়েছে, সেই সব জিনিস লাভ ছাড়া বিক্রি করা হচ্ছে। বিশেষ করে আমার গ্রীন হাউজে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো হয়নি। তাছাড়া এখানে জিনিসপত্র সবাইকে বন্টন করে দেয়া হচ্ছে।
ওজনপার্ক থেকে মোশাররফ হোসেন সবুজ জানান, ওজনপার্কে জিনিসপত্রে কিছুটা সংকট রয়েছে। তবে মালিকরা এখনো সেইভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়াননি। সবাইকে বন্টন করেই জিনিসপত্র দেয়া হচ্ছে।