১২ মার্চ, বৃহস্পতিবার, কলকাতা, বিকেল ৪টা
আজ সকাল থেকে ফোন আর এসএমএস। সকলের এক কথা ‘এখন শুট করতে লন্ডন যাওয়া ঠিক নয়।’ কাছের বন্ধুরা তো রীতিমতো চিৎকার করছে।
১২ মার্চ, বৃহস্পতিবার, কলকাতা, সন্ধে ৬টা
মেকআপ ম্যান বুম ফোন করল। ও দেখলাম প্যারানয়েড। কিন্তু আমি কী ভাবে বলি শুটিং ক্যানসেল? অসম্ভব! আমার পুরো শুটিং টিম আগেই পৌঁছে গিয়েছে। ওরা লন্ডনে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে তো যেতেই হবে।
১৩ মার্চ, শুক্রবার, কলকাতা বিমানবন্দর, রাত ২টা
এমিরেটস্-এর ফ্লাইট। একটু আগেই চলে এলাম। মাস্ক পরে পৌঁছলাম এয়ারপোর্ট। দেখলাম কলকাতা বিমানবন্দর স্বাভাবিক। আমি ঠিক করেছি আমাকে সতর্ক থাকতে হবে। আমি অবশ্য হাইজিন নিয়ে বরাবর খুঁতখুঁতে। এ বার তো সতর্কতা আরও অনেক বেশি।
১৩ মার্চ, শুক্রবার, কলকাতা বিমানবন্দর, ভোর ৫ টা
ফ্লাইটে উঠেই আমার সিট, কম্বল, আইপ্যাড, বিছানা, আর সামনের স্ক্রিন— সব স্যানিটাইজার দিয়ে মুছেছি আমি। ওয়াশরুমে কলের নব, বাথরুম সিট সব স্যানিটাইজার দিয়ে যতবার গিয়েছ ক্লিন করেছি। এমনকি, এয়ারপোর্টের টয়লেটেও হ্যান্ড শাওয়ার, নব সব স্যানিটাইজার দিয়ে ক্লিন করেছি। ফ্লাইটের দরজা বন্ধ হল। মনে মনে জগন্নাথ দেব-কে স্মরণ করে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিলাম।
১৩ মার্চ, শুক্রবার, দুবাই বিমানবন্দর, সকাল ১০টা
এ কী! এতবার এসেছি এখানে, আগে কখনও এত ফাঁকা দেখিনি। করোনার আঁচটা এখানে এসে সবচেয়ে বেশি টের পেলাম। স্কেয়ারি লাগছিল। ঝলমলে দুবাই এয়ারপোর্টকে অমন ব্ল্যাঙ্ক দেখে। প্রত্যেকটা শাটার নামানো। ওয়েটিং এরিয়াতেও কেউ নেই। শুধু আমরা ফ্লাইট থেকে কয়েক জন মানুষ নামলাম! এ বার একটু যেন ভয় ভয় লাগছে।
আরও পড়ুন: করোনার ফাঁদে গৃহবন্দি টলিপাড়ার ‘লাভ-বার্ডস’, কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন তাঁরা?
১৩ মার্চ, শুক্রবার, হিথরো এয়ারপোর্ট, বিকেল ৫টা
মাস্ক পরে নামলাম এয়ারপোর্টে। ফোন খুলে দেখলাম ‘টেক কেয়ার’ আর ‘কেন যাচ্ছ’ কমেন্টে ভর্তি ফোন। হিথরো এয়ারপোর্ট নেমে ভাল লাগছে। মোটের ওপর স্বাভাবিক। নিজের ছন্দেই যেন চলছে। দিব্যি মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুবাইয়ের থেকে একেবারেই আলাদা। কে বলবে এ দেশে করোনার মতো প্রাণঘাতী রোগ থাবা বসিয়েছে?
তখনও শুটিং চলছে লন্ডনে।—ছবি ফেসবুক থেকে।
১৪ মার্চ, শনিবার, লন্ডন সকাল ৮টা
শেডিউল অনুযায়ী শুটও চলছে। আজ আমার শুট নেই। ভাবলাম একটু ঘুরেই আসি। রাস্তায় হাঁটতে কার না ভাল লাগে? তাও আবার লন্ডনের রাস্তায়? ঠান্ডাও জমিয়ে আছে। বেশ লাগছিল হাঁটতে। অক্সফোর্ড স্ট্রিটে পৌঁছলাম। স্যানিটাইজার আমার সঙ্গী। মাস্কও পরেছি। কিন্তু রাস্তায় দেখি কেউ মাস্ক পরছে না। এ কী? কিছুই যেন হয়নি এমন চালে লোকজন হাঁটাচলা করছে। বাচ্চা, কমবয়সী, বয়স্ক…শনিবার বলে সব্বাই ছুটির মেজাজে। আমি তো অবাক!
১৪ মার্চ, শনিবার, লন্ডন, রাত ৯টা
দেশ থেকে শুধু ফোনে, হোয়াটস্অ্যাপে আতঙ্কের আঁচ। পরের দিন শুট। রাতে ঠান্ডা বাড়ল। শুয়ে পড়ছি এখন।
আরও পড়ুন: নির্দেশ অমান্য করে জিমে শাহিদ, নোটিস পাঠাল পুর নিগম
১৫ মার্চ, রবিবার, লন্ডন দুপুর ২টা
আমার শুট শুরু হল সকাল থেকে। ওখানেও ইউনিটের সবাই দেখলাম স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুচ্ছে। হাইজিনের ওপর নজর রাখছে। তবে শুটে আমি, জিৎদা, বিশ্বনাথ কেউ মাস্ক পরিনি। আরে মেক আপ করে তো আর মাস্ক পরা যায় না। এ দেশে কেউ তো মাস্ক পরছে না। দেশে ফিরে মাস্কের বিষয়টা নিয়ে আর একটু ক্লিয়ার করতে হবে।
১৫ মার্চ, রবিবার, লন্ডন রাত ১০টা
শুট চলছে…বিকেলের দিকে সে দিন প্রথম লোকাল কোঅর্ডিনেটরের কাছে শুনলাম, করোনা খুব তাড়াতাড়ি ছড়াচ্ছে বলে স্কুল, কলেজ এ বার হয়তো লন্ডনে বন্ধ হবে। এই প্রথম করোনার কথা কানে এল।আর অক্সফোর্ড স্ট্রিটেই শুট হচ্ছে আমাদের। এ ভাবেই কাটল আর একটা দিন।ঠান্ডা বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে।দেখা যাক কাল কী হয়!
১৬ মার্চ, সোমবার, অক্সফোর্ড স্ট্রিট, লন্ডন, রাত ৯টা
সকাল থেকে আজও আমরা শুটে। আজ কোঅর্ডিনেটরের গলা অন্য রকম। শোনা গেল করোনা তাড়াতাড়ি ছড়াচ্ছে। আর দেশ থেকেও ফোন আসা বাড়তে লাগল। সক্কলে প্যানিক করছে। টেক্সট আসছে ‘কামব্যাক মিমি’। বুঝতে পারছি না কী হবে। শুটের ছবিও পোস্ট করলামএটা বোঝাতে, আমরা ভাল আছি, কাজ করছি। কিন্তু সব মিলিয়ে বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা হয়তো হবে। শুট চলছিল…সন্ধেবেলায় খবর এল আমাদের শুট বন্ধ করে পরের দিন ভোরের ফ্লাইটেই ফিরতে হবে। জরুরি অবস্থা। আর নয়। সরকার থেকে বলেছে ১৮ মার্চের মধ্যেই দেশে ফিরতে হবে।কোনওমতে জিনিস গুছিয়ে নিলাম। রাতেই মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হল। মা কে বললাম সবাই এত ফোন করছে, টেনশন করছে তুমি একবার ফোন করবে তো? তোমার টেনশন হচ্ছে না? ফোনের ওপারে মায়ের গলা স্বাভাবিক। মা বলল, ‘তুই সকলের সঙ্গে কাজে গিয়েছিস। সকলের সঙ্গেই তো আছিস। সকলের যা হবে তোরও তাই হবে।’ আমি জানি মা এ রকম কিছুই বলবে। ছোট থেকেই আমার কাজ, আমার সিদ্ধান্তের ওপর মায়ের অগাধ আস্থা। মা জানে, আমি এতটাই শক্তসমর্থ, যে কোনও পরিস্থিতিতেই আমি ঠিক ফাইট করে বেরিয়ে আসব।
১৭ মার্চ, মঙ্গলবার, লন্ডন, ভোর ৫টা
খুব ভোরের ফ্লাইট। আমরা ফিরছি। কিন্তু লন্ডনে তখনও শাটডাউন, লকডাউন কিছুই দেখছি না। কী যে হচ্ছে! ভোরবেলার চেনা হিথরো দেখলাম খানিক বদলেছে। একটু ফাঁকা ফাঁকা যেন।
১৮ মার্চ, বুধবার, কলকাতা, সন্ধে ৬টা
কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছলাম ৭টা নাগাদ। এ বার আসল পরীক্ষা। এর মাঝেও আমি আর জিৎদা স্যানিটাইজার ব্যবহার করা থেকে গ্লাভস চেঞ্জ করা সব করেছি। বিমানবন্দর বেশ ফাঁকা। আমার মেডিক্যাল স্ক্রিনিং শুরু হল। এই প্রথম কেমন দু’সেকেন্ডের জন্য ভয় করে উঠল। স্ক্রিনিং মনিটরের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে জম্বি মনে হচ্ছিল। পা থেকে মাথা স্ক্রিন করা হল। লাল, সবুজ রং হয়ে আসছিল কী সব। মাথায় কী একটা ঠেকাল। তারপর পরীক্ষায় পাশ করলাম। উফফফ! ওই সময়টা একটু কেমন লেগেছিল। টিমের সকলের ওই পদ্ধতিতে স্ক্রিনিং হওয়ার পর বাড়ি এলাম। এখন বাড়িতে। সেই কনকনে ঠান্ডা নেই। বেশ ফুরফুরে সন্ধে। এখন কোনও তাড়া নেই। কাজ নেই। দেখতে পাচ্ছি, আমার পঁয়ষট্টি বছরের বাবা আমার থেকে অনেক দূরে বাড়ির আর এক প্রান্তে বসে।আমি লন্ডনে যাওয়ায় আমার বাড়ির দুটো বাচ্চা, অফিস, লোকজন দেখাশোনা করার জন্য মেয়ের বাড়িতে এসেছিল বাবা। মা জলপাইগুড়িতে। এত দিন পর মেয়েকে ফিরতে দেখে বাবা আমার কাছেই চলে আসছিল। আমি কোনওমতে ঠেকাই।
আমার ঘরে এখন বন্দি আমি। বাচ্চা দুটোকেও কাছে আসতে দিচ্ছি না। ওরা আমার প্রাণ। ডিসপোজেবল প্লেটে খাবার খাচ্ছি। আমার হাউজস্টাফরা কেউ কাছে আসছে না। বাইরের কোনও লোকও না। কিচেনে অবধি যাইনি। এ ভাবে চোদ্দো দিন নিজের হয়ে থাকব। থাকতে আমাকে হবেই। যদি আমার কিছু হয়েও থাকে সেটা মিমি চক্রবর্তী অবধি থাক… এটাও একটা লড়াই।