মহৌষধ একটি না, দুটি। সবাই জানি কিন্তু দাম দিই না। প্রথমটি হলো সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি সব সময় মেনে চলা। আর দ্বিতীয়টি, যা প্রথমটির অবিচ্ছেদ্য অংশ—প্রতিদিন কিছু ব্যায়াম। এই দ্বিতীয়টি নিয়েই শুরু করি। এটা ম্যাজিকের মতো কাজ দেয়। করোনাভীতির এই দুঃসময়ে এখন সবার নিয়মিত দিনে অন্তত ৩০ মিনিটের দুটি সহজ ব্যায়াম করা দরকার। ১৫ মিনিট স্ট্রেচিং ও ব্রিদিং। আর সেই সঙ্গে পরিষ্কার বাতাসে ১৫ মিনিট জোরে হাঁটা। এ ধরনের ব্যায়াম আমাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ায় এবং সেটা করোনা থেকে শুরু করে অন্য রোগশোকের মোক্ষম ওষুধ হিসেবে কাজ করে।
কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে দেখুন ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’-এর একটি লেখা। চার-পাঁচ দিন আগে, ১০ মার্চ বিশ্বখ্যাত সেই পত্রিকায় করোনাভাইরাস-আতঙ্কের পটভূমিতে ‘ক্যান আই বুস্ট মাই ইমিউন সিস্টেম?’ (আমি কি আমার রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়াতে পারি?) শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়েছে। মা-বাবা থেকে প্রাপ্ত জিনগত বৈশিষ্ট্য এ ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই ভূমিকা রাখে। কিন্তু তার সঙ্গে আরও কিছু ব্যাপার আছে। দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ কমাতে হবে। ভালো ঘুম। পুষ্টিকর খাবার, বিশেষত পরিমাণমতো ভিটামিন ডি এবং নিয়মিত ব্যায়াম। গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া নির্মূলে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। সব মিলিয়ে দেহের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ে। যেহেতু রোগটা খুবই ছোঁয়াচে, তাই এ ব্যাপারে সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে তো হবেই। এই কয়েকটি পদক্ষেপ করোনাভাইরাস কাবু করার অন্যতম উপায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসকে ‘বৈশ্বিক মহামারি’ হিসেবে ঘোষণা করার পর মানুষ আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তাহলে কি সেই আগের দিনের প্লেগ, কলেরা, বসন্তের মতো মহামারিতে অসহায়ভাবে মরতে হবে?
না, তা নয়। চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই যেসব পরামর্শ দিয়েছেন, সে তো বললামই।
কয়েক দিন আগেও আমরা ভাবতাম, করোনাভাইরাস রোগটি শুধু চীনের ব্যাপার এবং ইবোলা, সার্স প্রভৃতি সাম্প্রতিক ভয়াবহ রোগের মতো এটিও হয়তো কিছুদিন পর চলে যাবে। এ রোগের প্রতিষেধক বের হবে ইত্যাদি। কিন্তু রোগটি এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। চীনের পর যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ইতালি, ইরান প্রভৃতি দেশেও বিভিন্ন উপদ্রুত অঞ্চলে জনসমাগম বন্ধ, স্কুল-কলেজ বন্ধ করা হয়েছে। দোকানপাটও বন্ধ। করোনাভাইরাস ঠেকানোর জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউরোপ থেকে বেশির ভাগ পর্যটকের ওপর এক মাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। অবশ্য ব্রিটেনকে ছাড় দিয়েছেন।
অনেক দেশে বিমান চলাচল কমে গেছে। শিল্প-উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ রকম আগে কখনো দেখা যায়নি।
এত ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টির একটি কারণ সম্ভবত এই যে, রোগটি ঠিক কোন মাধ্যমে কীভাবে ছড়ায়, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সাধারণভাবে বলা হচ্ছে, আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়, তাই মাস্ক পরুন। আবার আমাদের দেশেরই অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলছেন, মাস্ক না পরলেও চলে। এই ভাইরাসটি তুলনামূলক ভারী (মাইক্রো লেভেলে), তাই অন্য কোনো ব্যক্তি থেকে তিন বা ছয় ফুট দূরে থাকলেই চলবে, তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাসে সংক্রমণ ঘটবে না। আবার প্রায় সবাই বলছেন, কিছুক্ষণ পরপর স্যানিটাইজার বা সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে পরিষ্কার থাকতে হবে; হ্যান্ড শেক না করা ইত্যাদি। এসব অবশ্য সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী মেনে চলতেই হবে।
রোগের লক্ষণ পরিষ্কার—জ্বর, কাশি ইত্যাদি। এরপর ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটলে বিপজ্জনক মোড় নেয়। এটাও দেখা গেছে, কমবয়সীদের সংক্রমণ কম, বয়স্কদের ভয় বেশি। যাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কম, তাদের আশঙ্কা বেশি। এটাই স্বাভাবিক।
অন্যদিকে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলেও মৃত্যুর হার তুলনামূলক কম। দেখা গেছে ইবোলা বা আরও কিছু রোগে মৃত্যুহার বেশি।
তাহলে কেন বিশ্বজুড়ে এত তোলপাড়? একজন চিকিৎসক বলেছেন, রোগের বাহক এখনো অজানা এবং ওষুধও আবিষ্কার হয়নি। তাই এ অবস্থা। যেমন আমরা জানি মশা ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। তাহলে ভয় থাকলেও আশঙ্কা কম, কারণ মশা এড়িয়ে চললে রোগ থেকে বাঁচা যায়, এটা সবাই জানলাম। ইবোলা ভাইরাসের বাহক বাদুড়, এটা জানার পর ভয় কেটে গেছে। নিপাহ ভাইরাসের বাহক বাদুড়, এটা জানার পর আমাদের গ্রামের মানুষও জাল দিয়ে ঘিরে খেজুরের রস সংগ্রহ করেন। লিচুগাছ জাল দিয়ে ঘিরে বাদুড় ঠেকায়। ব্যস, আতঙ্ক কমে গেছে। সোয়াইন ফ্লু ছড়ায় শূকর, বার্ড ফ্লু ছড়ায় মুরগির খামার, সার্স ছড়ায় বাদুড় বা পশু। এসব জানার পর আর পেনডেমিক বা বৈশ্বিক মহামারির প্রশ্ন ওঠেনি।
আর একটি কারণ হলো, এই রোগের চিকিৎসা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। চীনসহ কয়েকটি দেশ বলেছে ওরা বের করেছে, খুব শিগগিরই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রতিষেধক বাজারে ছাড়বে। কিন্তু এখনো কোনো প্রতিষেধক বা টিকা আবিষ্কার হয়নি।
যদি জানা যেত, ঠিক কীভাবে রোগটি ছড়ায় এবং যদি এর প্রতিষেধক পাওয়া যেত, তাহলে হয়তো বিশ্বজুড়ে এমন আতঙ্ক হতো না।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহর সঙ্গে আলাপ করলে তিনি বলেন, অবিলম্বে এ রোগের প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার হলেই সব ভয় কেটে যাবে। তিনি বলেন, আতঙ্ক নয়, বরং সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই অনেক সহজে করোনার সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব।এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলেও মৃত্যুর হার কম। কম বয়সীরা সাধারণ অসুস্থতায় দু-চার দিন থাকার পর সুস্থ হয়ে যায়। শুধু বয়স্ক ও রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা যাঁদের কম, তাঁদেরই ভয় বেশি। সুতরাং করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য একটু সাবধানতাই এখন সবচেয়ে বেশি দরকার। কারও জ্বর-কাশি হলে নিজ উদ্যোগে বাসায় সাবধানে থাকা। অন্যদের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি না করা। হাঁচি দিতে সাবধান, নাক-মুখের সামনে রুমাল বা টিস্যু ব্যবহার, ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটার কোনো লক্ষণ, যেমন শ্বাসকষ্ট হলেই কেবল হাসপাতালে যাওয়া দরকার, অন্যথায় নয়।
সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, দুশ্চিন্তামুক্ত নিশ্চিন্ত ঘুম, পুষ্টিকর খাবার, নিয়মিত ব্যায়াম—এই কয়েকটি বিষয় এখন সবার জন্য খুব জরুরি।
আব্দুল কাইয়ুম, মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক
প্রথম আলো