২০১১ সালের শেষভাগ। প্রথমদিকে নাটকীয় অগ্রগতির পর লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে তখন কয়েকমাস ধরে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। ন্যাটো সমর্থিত বিদ্রোহীরা একদিন একটা এলাকা দখল করে, তো পরদিনই গাদ্দাফীর সেনাবাহিনী আবার সেই এলাকা পুনরুদ্ধার করে ফেলে। হোয়াইট হাউজ সিদ্ধান্ত নিল, এ অবস্থা আর বেশি দিন চলতে দেয়া যায় না। এমন কোনো উদ্যোগ নিতে হবে, যেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে গাদ্দাফীর সরকারের পতন ঘটে। হোয়াইট হাউজের অনুরোধে গাদ্দাফীর পতন ঘটানোর সেই গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন সিআইএর উপ-পরিচালক মাইকেল মোরেল।
এক সকালে নিজের অফিসের নিরাপদ ফোন লাইন থেকে মাইকেল মোরেল সরাসরি রিং করলেন লিবিয়ার গোয়েন্দাবাহিনীর প্রধান আব্দুল্লাহ সেনুসিকে। তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার। সেনুসিকে তিনি গাদ্দাফীর বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য এমন একটি অফার দিবেন, যা সেনুসি ফিরিয়ে দিতে পারবে না। সেনুসির অফিসের ফোনে রিং বাজতে শুরু করল। আর এদিকে দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগলেন মোরেল। কারণ, সেনুসি শুধু গাদ্দাফীর গোয়েন্দাবাহিনীর প্রধানই নন, একইসাথে তিনি গাদ্দাফীর আপন ভায়রা ভাইও। মোরেল কি আসলেই পারবেন গাদ্দাফীর বিরুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে সেনুসিকে রাজি করাতে?
গাদ্দাফীকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টা আমেরিকার এটাই প্রথম ছিল না। ১৯৬৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরপরই যখন গাদ্দাফী লিবিয়া থেকে মার্কিন এবং ব্রিটিশ সেনা ও বিমান ঘাঁটিগুলো উচ্ছেদ করেন, তেল উত্তোলনের পুরানো সব চুক্তি বাতিল করে নতুন করে চুক্তি করতে তাদেরকে বাধ্য করেন, তখন থেকেই গাদ্দাফী হয়ে ওঠেন আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের অন্যতম প্রধান শত্রু। সমগ্র আশি এবং নব্বইয়ের দশক জুড়ে সিআইএর পরিকল্পনায় আমেরিকা একাধিকবার গাদ্দাফীকে হত্যার চেষ্টা করেছে। কখনো সরাসরি বিমান হামলার মাধ্যমে, কখনো বিদ্রোহী কোনো গ্রুপকে ট্রেনিং এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে অভ্যুত্থান করতে পাঠানোর মাধ্যমে।
কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষভাগ থেকে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টাতে শুরু করে। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ শেষে এ সময় আফগান ফেরত জিহাদীরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এবং সেসব দেশের স্বৈরশাসকদেরকে উৎখাত করে ইসলামিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ১৯৯৬ সালে আল-ক্বায়েদার সাথে সম্পৃক্ত লিবিয়ান ইসলামিক ফাইটিং গ্রুপ গাদ্দাফীকে হত্যার উদ্দেশ্যে অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয়। প্রতিক্রিয়ায় গাদ্দাফী আল-ক্বায়েদাসহ সব ধরনের ইসলামপন্থী গ্রুপের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যান। এরই ধারাবাহিকতায় ৯/১১ এরও তিন বছর আগে, ১৯৯৮ সালে লিবিয়া ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
এরকম পরিস্থিতিে ১৯৯৮ সালে আল-ক্বায়েদা যখন কেনিয়া এবং তাঞ্জানিয়ার মার্কিন দূতাবাসে বোমা হামলা করে, তখন উভয়ের কমন শত্রু আল-ক্বায়েদার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে গাদ্দাফীকে উৎখাতের মিশন থেকে সরে আসতে শুরু করে। পরবর্তী বছরগুলোতে লিবিয়ার সাথে আমেরিকা এবং ব্রিটেনের সম্পর্কের আরো উন্নতি ঘটে। ৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলার পর লিবিয়ান গোয়েন্দাবাহিনীর সাথে সিআইএ এবং এমআইসিক্সের সন্দেহভাজন আল-ক্বায়েদা বন্দীদের আদান-প্রদান এবং জিজ্ঞাসাবাদ কর্মসূচী শুরু হয়। আমেরিকার ইরাক আক্রমণের পর গাদ্দাফী যখন তার পারমাণবিক কর্মসূচী বাতিল করেন, তখন লিবিয়ার সাথে আমেরিকা এবং ব্রিটেনের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হয়।
২০০৬ সালে দীর্ঘ ২৭ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে লিবিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়াতে দূতাবাস চালু করে এবং রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করে। দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন ব্যবসায়িক এবং সামরিক চুক্তিও সম্পাদিত হয়। ২০১১ সালের আরব বসন্তের পূর্ব পর্যন্ত মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি দল লিবিয়ান সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজেও নিয়োজিত ছিল, যেন তারা লিবিয়ার দক্ষিণের বিশাল বিস্তৃত সীমান্তে আল-ক্বায়েদার বিরুদ্ধে সফলভাবে অপারেশন চালাতে পারে। কিন্তু ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখে যখন আরব বসন্ত লিবিয়াতে এসে হাজির হয়, তখনই লিবিয়া এবং আমেরিকার বন্ধুত্ব তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে।
২০১০ সালের শেষের দিকে, যখন লিবিয়ার সাথে আমেরিকার সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো ছিল, তখন সিআইএর উপ-পরিচালক মাইকেল জোসেফ মোরেল প্রথমবারের মতো লিবিয়া সফর করেন। তার সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আল-ক্বায়েদার বিরুদ্ধে দুই দেশের লড়াইকে সমন্বিত করা। ঐ সফরে লিবিয়াতে তার হোস্ট ছিলেন গাদ্দাফীর ভায়রা এবং লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দাবাহিনীর প্রধান, আব্দুল্লাহ সেনুসি। সেনুসির সাথে মোরেলের বেশ দীর্ঘ একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু বৈঠকের বিষয়বস্তু শুধু উভয় দেশের নিরাপত্তা এবং স্বার্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা দুজনেই তাদের নিজেদের সম্পর্কে, তাদের পরিবার সম্পর্কেও আলাপে মেতে উঠেছিলেন। বৈঠক শেষে দুজনেই বুঝতে পেরেছিলেন, তাদের নিজ নিজ কঠোরতা সত্ত্বেও পরস্পরের মধ্যে এক ধরনের আন্তরিকতার সম্পর্কে গড়ে উঠেছে।
দুটি দেশের মধ্যে, বিশেষ করে দুই দেশের গোয়েন্দাবাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা অনেক সময়ই গড়ে ওঠে এর বাহিনীগুলোর প্রধানদের মধ্যকার ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। কাজেই মোরেলের লিবিয়া ভ্রমণের কয়েকমাস পরেই যখন লিবিয়াতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে, এবং তার ফলে লিবিয়ার সাথে আমেরিকার সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে, তখনও মোরেল এবং সেনুসির মধ্যে গড়ে ওঠা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ফলে দেশ দুটির মধ্যে যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগের একটি সম্ভাবনার দ্বার খোলা ছিল।
যোগাযোগের প্রয়োজনটা প্রথমে আমেরিকাই অনুভব করে। ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখে বিদ্রোহ ছড়িয়ে যাওয়ার পরপরই আমেরিকা তাদের দূতাবাসের সকল স্টাফকে ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু দূতাবাস থেকে ত্রিপলীর সী-পোর্ট পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার পথও সেই উত্তাল সময়ে তাদের কাছে যথেষ্ট নিরাপদ বলে মনে হচ্ছিল না। ফলে ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে মোরেল সেনুসিকে ফোন করে অনুরোধ করেন মার্কিন নাগরিকদেরকে নিরাপদে সী-পোর্টে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য। সেনুসি মোরেলকে কথা দেন, তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সত্যিই তিনি তার কথা রেখেছিলেন। প্রায় দুই শতাধিক মার্কিন নাগরিক লিবিয়ান নিরাপত্তাকর্মীদের প্রহরায় কোনো রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই লিবিয়া ত্যাগ করতে পেরেছিল।
সেনুসির সাথে মোরেল দ্বিতীয়বার যোগাযোগ করেন মার্চ মাসে, যখন নিউ ইয়র্ক টাইমসের চারজন সাংবাদিক গাদ্দাফীর সেনাবাহিনীর হাতে আটক হয়। এবারও মোরেলের অনুরোধে সেনুসি যথাসময়ে সাংবাদিকদেরকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সেনুসির এই উপকারগুলো অবশ্য একেবারে নিঃস্বার্থ ছিল না। মোরেলের সাথে যখনই তার ফোনালাপ হতো, তখনই তিনি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন, আমেরিকা বিদ্রোহীদেরকে সাহায্য করার মধ্য দিয়ে বড় ধরনের ভুল করছে। কারণ গাদ্দাফীর বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করছে, তারা সবাই আল-ক্বায়েদার সদস্য এবং গাদ্দাফীর পতনের পর একদিন তারা আমেরিকার উপরেই আঘাত করবে।
সেনুসির দাবি অবশ্য কিছুটা অতিরঞ্জিত ছিল। বিদ্রোহীরা সবাই আল-ক্বায়েদা ছিল না, তাদের মধ্যে সমাজের প্রায় সব ধরনের মানুষই ছিল। তবে একইসাথে এটাও সত্য, শুরু থেকেই বিদ্রোহীদের সাথে আসলেই কিছু হলেও আল-ক্বায়েদার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ছিল, যা সময়ের সাথে সাথে কেবল বৃদ্ধিই পেয়েছিল। এবং সেনুসির ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্যে পরিণত করে গাদ্দাফীর পতনের মাত্র এক বছরের মাথায়ই এই আল-ক্বায়েদার সাথে সম্পৃক্ত বিদ্রোহীরাই বেনগাজীতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করেছিল। কিন্তু ২০১১ সালে আমেরিকা আল-ক্বায়েদার হুমকিকে উপেক্ষা করে গাদ্দাফীকে ক্ষমতাচ্যুত করতেই বেশি আগ্রহী ছিল।
সেনুসির সাথে মাইকেল মোরেল তৃতীয়বার যোগাযোগ করেন ২০১১ সালের মে মাসে। তখনও পর্যন্ত কোনো উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তা সরাসরি গাদ্দাফীর পদত্যাগ দাবি করেননি। তারা আশা করেছিলেন হয়তো বিদ্রোহীরা নিজেরাই কাতার এবং ফ্রান্সের সহায়তায় গাদ্দাফীকে উৎখাত করতে সক্ষম হবে, অথবা গাদ্দাফী চাপের মুখে নতি স্বীকার করে নিজেই পদত্যাগ করবেন বা পালিয়ে যাবেন। কিন্তু মে মাসের দিকে যখন যুদ্ধে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়, তখন ওবামা প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয় তাদেরকে লিবিয়ার ব্যাপারে পরিষ্কার একটা অবস্থান নিতে হবে। ফলে মোরেল আবারও সেনুসির সাথে যোগাযোগ করেন এবং তার মাধ্যমে গাদ্দাফীকে জানিয়ে দেন, লিবিয়ার সমস্যা সমাধানের একটাই উপায়, গাদ্দাফীকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে।
সেনুসির সাথে মোরেল শেষবারের মতো যোগাযোগ করেন এর কয়েকমাস পরেই। যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন দেখতে না পেয়ে মোরেল সিদ্ধান্ত নেন, তিনি নিজেই সেনুসিকে গাদ্দাফীর পক্ষ ত্যাগের প্রস্তাব দিবেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রীসহ অনেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা আগেই গাদ্দাফীর পক্ষ ত্যাগ করে বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দিলেও গাদ্দাফীর নিকটাত্মীয়দের মধ্যে কেউ তখনও পর্যন্ত পদত্যাগ করেনি। মোরেলের যুক্তি ছিল, সেনুসির মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিকে যদি পদত্যাগ করতে রাজি করানো যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে তা গাদ্দাফীর জন্য বড় ধরনের আঘাত হবে এবং সম্ভবত তা গাদ্দাফীর নিশ্চিত পতনকে আরও ত্বরান্বিত করবে।
মোরেল সেনুসির সাথে ফোনে এসব কথা আলাপ করতে রাজি ছিলেন না। কারণ যদিও সেনুসি নিজেই অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান, কিন্তু এমন সম্ভাবনাও ছিল, গাদ্দাফী হয়তো তার উপরেও অন্য কারো দ্বারা গোয়েন্দাগিরি করাচ্ছিলেন। সেরকম কিছু হয়ে থাকলে একটি ফোনালাপই হতে পারত সেনুসির মৃত্যুর কারণ। মোরেল তাই সেনুসিকে গোপনে সংবাদ পাঠান মিসর অথবা তিউনিসিয়ায় গিয়ে তার সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করার জন্য। সেনুসি প্রথমে রাজি হয়েছিলেন, তিউনিসিয়ার জেরবাতে তিনি মোরেলের সাথে দেখা করবেন। কিন্তু দুই দিন পরেই তিনি সংবাদ পাঠান, তিউনিসিয়াতে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তিনি বড়জোর তিউনিসিয়া-লিবিয়ার সীমান্তে মোরেলের সাথে দেখা করতে পারবেন।
মোরেল তাতেও রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু মিটিংয়ের নির্ধারিত তারিখের এক সপ্তাহ আগে সেনুসি আবারও সংবাদ পাঠান, তার পক্ষে সেখানেও যাওয়া সম্ভব হবে না। মোরেল বুঝতে পারেন, সেনুসি ত্রিপলী ছাড়ার জন্য গাদ্দাফীর কাছ থেকে অনুমতি পাননি। কারণ সে সময় এরকম একাধিক ঘটনা ঘটেছিল, যেখানে গাদ্দাফীর সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অসুস্থতা বা অন্য কোনো অযুহাতে বিদেশে গিয়েই পদত্যাগ করে বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছিল। সেনুসিকে গাদ্দাফী এই সুযোগ দিতে রাজি ছিলেন না।
বাধ্য হয়ে সিআইএর উপ-পরিচালক মোরেল সেনুসিকে সরাসরিই ফোন করেন। সেনুসিকে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন, গাদ্দাফীর সময় ঘনিয়ে আসছে। আজ হোক, কাল হোক, গাদ্দাফীর পতন ঘটবেই। কাজেই গাদ্দাফীর সাথে না থেকে এই মুহূর্তে বরং সেনুসির উচিত তার নিজের জন্য, পরিবারের জন্য এবং দেশের ভবিষ্যতের জন্য যেটা ভালো, সেটাই করা। তার উচিত সময় থাকতেই গাদ্দাফীর পক্ষ ত্যাগ করা এবং ভবিষ্যত লিবিয়াতে নিজের এবং নিজের পরিবারের একটি সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করা। কিন্তু মোরেলকে অবাক করে সেনুসি উত্তর দেন, “না, এই বিপদের মুহূর্তে আমি আমার নেতাকে ছেড়ে যেতে পারব না।”
নিরুপায় হয়ে মোরেল তার সর্বশেষ অস্ত্র প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এক বছর পূর্বে সেনুসির সাথে যখন তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল, তখন তারা দুজনেই খোলা মনে নিজেদের পরিবারের গল্প করেছিলেন। সে সময়ই মোরেল লক্ষ্য করেছিলেন, এই পৃথিবীতে সেনুসির সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি ছিল তার কিশোরী কন্যা আনুদ। সেনুসির গল্পে ঘুরেফিরেই আনুদের কথা আসছিল। তাকে নিয়ে সেনুসির অনেক গর্ব, অনেক আশা ছিল। সিআইএর উপ-পরিচালক মোরেল সে সময়ই তথ্যটি নিজের মনের মধ্যে গেঁথে রেখেছিলেন। আজ এই মোক্ষম সময়ে তিনি তা কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
আব্দুল্লাহ সেনুসিকে উদ্দেশ্য করে মাইকেল মোরেল বললেন,
আব্দুল্লাহ, আর কিছু না হলেও আপনি আপনার মেয়ের কথা ভাবুন। তার ভবিষ্যতের কথা ভাবুন। গাদ্দাফীর পক্ষ ত্যাগ করার মধ্য দিয়েই কেবল আপনি তাকে বাঁচাতে পারবেন। লিবিয়াতে তার একটি ভবিষ্যত থাকবে।
মোরেল আশা করেছিলেন মেয়ের ভবিষ্যতের কথা শুনলে হয়তো সেনুসি দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে। কিন্তু এক মুহূর্তও চিন্তা না করে সেনুসি যে উত্তর দিলেন, তা শোনার জন্য মোরেল প্রস্তুত ছিলেন না। দৃঢ় কণ্ঠে সেনুসি উচ্চারণ করলেন, “মাইকেল, আমার কাছে আমার পরিবারের চেয়েও আমার নেতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ!” মোরেল বুঝতে পারলেন, এরকম নিঃস্বার্থ আনুগত্য যার, তাকে কোনো যুক্তি দেখিয়ে টলানো যাবে না। আস্তে করে ফোন রেখে দিলেন তিনি।
দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আব্দুল্লাহ সেনুসি নিষ্পাপ কোনো ব্যক্তি ছিলেন না। হাজার হাজার লিবিয়ানের রক্ত তার হাতে লেগে আছে। আশির দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে গাদ্দাফীর সমালোচকদেরকে অপহরণ করে লিবিয়াতে নিয়ে আসা, বা বোমা বিস্ফোরণে তাদেরকে হত্যা করা, গুম করে ফেলাসহ অসংখ্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। ১৯৯৬ সালে ত্রিপলীর আবুসেলিম কারাগারে যে প্রায় ১,২০০ বন্দীর উপর গণহত্যা চালানো হয়েছিল, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী সেটাও ঘটেছিল সেনুসির নির্দেশেই। কিন্তু তারপরেও নিজের নিশ্চিত পরিণতি জেনেও শেষমুহূর্ত পর্যন্ত গাদ্দাফীর সাথে থেকে তিনি প্রমাণ করেছেন, অনেক অপরাধে অপরাধী হলেও তিনি অন্তত বিশ্বাসঘাতক ছিলেন না।
গাদ্দাফীর পতনের পর আব্দুল্লাহ সেনুসি মৌরিতানিয়াতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। নতুন সরকার সেখান থেকে তাকে ফিরিয়ে এনে কারাবন্দী করে। সেই থেকে তিনি এখনও বন্দী আছেন। তার কন্যা আনুদও ২০১২-১৩ সালে ১০ মাস জেল খেটেছে। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর স্বল্প সময়ের জন্য অপহরণও করা হয়েছিল তাকে। সেনুসির বিচার চলছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। ৬৭ বছর বয়সী সেনুসি হয়তো মৃত্যুবরণ করবেন জেলের ভেতরে থেকেই। কিন্তু তার বিভিন্ন অপরাধের কাহিনীর পাশাপাশি ইতিহাসে রয়ে যাবে নেতৃত্বের প্রতি তার নিঃশ্বর্ত আনুগত্যের কথাও।